— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বাড়িতে অতিথিরা এসেছেন। বাড়ির বছর পাঁচেকের শিশুটির জন্য আনা উপহারের তালিকায় রয়েছে চকলেটও। সেগুলি পেয়ে শিশুটি খুশি হলেও চিন্তায় পড়েন তার বাবা-মা। কারণ, তাঁদের আশঙ্কা, পাঁচ বছর বয়সেই দাঁতের যেমন অবস্থা, তাতে চকলেট খেলে দাঁত আরও খারাপ হয়ে যাবে।দন্ত চিকিৎসকেরা অবশ্য জানাচ্ছেন, চকলেট খাওয়া যতটা সমস্যার, তার চেয়ে খাওয়ার পরে মুখ না ধোয়া বেশি সমস্যার। দাঁতের ঠিক মতো যত্ন না নিলে স্থায়ী দাঁত তো বটেই, দুধের দাঁতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কষ্ট পেতে পারে শিশুরা।
কেন জরুরি দাঁতের যত্ন
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দাঁত এক রকম ক্যালসিফায়েড গঠন, তাই দাঁতে ক্ষয় হলে বা ভেঙে গেলে সেই ক্ষতি পূরণ করাও সম্ভব হয় না। তাই দাঁতের যত্ন জরুরি শিশুকাল থেকেই। খাওয়া ছাড়াও দাঁতের একাধিক কাজ রয়েছে। দাঁত পড়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে যে শুধু খাবার খেতে অসুবিধে হয় বা দেখতে খারাপ লাগে তা নয়, সমস্যা হতে পারে স্পষ্ট উচ্চারণে এবং চোয়াল ও মুখের গঠনেও।
এই যত্ন কবে থেকে শুরু হবে?
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শিশুর জন্মের পরে দাঁত উঠলেও, গর্ভে থাকাকালীনই সব দাঁত তৈরি হয়ে যায়। তাই শিশুর বৃদ্ধি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে দাঁতের গঠনও গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টিকর, সুষম খাবার খাওয়ার উপরে নির্ভরশীল। গর্ভাবস্থায় মায়ের জ্বর হলে বা কোনও ওষুধের জন্য শিশুর দাঁতের গঠনের উপরেও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।
দুধের দাঁতের যত্ন
দুধের দাঁতের সময় থেকেই দাঁতের যত্নের দিকে খেয়াল রাখার কথা জানাচ্ছেন দন্ত চিকিৎসক পারমিতা গঙ্গোপাধ্যায়। কারণ এই সময়ে দাঁতের সংক্রমণ হলে তা পরবর্তী কালে স্থায়ী দাঁতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। শিশুরা দুধ বা ফর্মুলা খেলে মুখের মধ্যে তার অবশেষ রয়ে যায়। সেখান থেকেই দাঁতের ক্ষয় শুরুর আশঙ্কা থেকে যায়। দাঁত ওঠার সময় থেকে সেমি-সলিড খাবারের অভ্যেস করানোর পাশাপাশি বোতলে খাবার খাওয়ানো কমানো দরকার বলে জানাচ্ছেন তিনি। এর ফলে দাঁতের গঠন ঠিক থাকবে। দাঁত উঠে গেলে কিছু খাওয়ার পরে অল্প করে জল খাওয়াতে হবে যাতে অবশেষ ধুয়ে যেতে পারে। শিশু আরও একটু বড় হলে ফিঙ্গার ব্রাশিং বা নরম, পরিষ্কার কাপড় দিয়ে দাঁত মাজানোর অভ্যেস করানো জরুরি। এর পরে ধীরে ধীরে শিশুদের উপযুক্ত ব্রাশ দিয়ে দাঁতমাজা শুরু করাতে হবে। কিছু খাওয়ার পরে ভাল করে কুলকুচি করার অভ্যেসও জরুরি। স্বাস্থ্য সংক্রান্তঅন্য সমস্যা এড়ানোর পাশাপাশি দাঁত ভাল রাখতেও শিশুদের খাদ্যতালিকায় চিনি ও রিফাইন্ড শর্করার পরিমাণ কমাতে হবে।
পাঁচ-ছয় বছরের পরে
মোটামুটি ছ’-সাত বছরের পর দুধের দাঁত পড়ে গিয়ে স্থায়ী দাঁত উঠতে শুরু করে। পারমিতা বলছেন, ‘‘যে সময়ে মুখের মধ্যে দু’রকম দাঁত একসঙ্গে থাকে, সেই সময়ে দাঁতের যত্নে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এই সময়ে মাড়ি ফুলে যেতে পারে, যাকে ইরাপশন জিঞ্জিভাইটিস বলা হয়। মাড়িতে ব্যথার জন্য দাঁত মাজতেও অসুবিধে হয়। এই সময়ে একবার দন্ত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি, সাধারণ চেকআপের জন্য। সাধারণত দাঁতের চিকিৎসক নিয়ে শিশুদের মনে একটা ভয় কাজ করে। কিন্তু দাঁতের চিকিৎসা মানেই যে দাঁত তোলা বা ব্যথা, এই ধারণা থেকে শিশুদের বার করে আনাও সম্ভব হবে চেকআপের মাধ্যমে।’’
তিনি জানাচ্ছেন, এই সময়ে কিছু শক্ত জিনিস চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যেস করা জরুরি। এর ফলে দাঁতের আশপাশের পেশি শক্ত হয়, দাঁত ভাল থাকে। তাই ফলের রস না দিয়ে আপেল, শসার মতো ফল টুকরো করে কেটে দিলে শিশুরা তা চিবিয়ে খেতে পারে। দেহের আর-পাঁচটা অঙ্গের মতোই নিয়মিত ব্যবহারে দাঁত ভাল থাকে।
স্থায়ী দাঁত ওঠার পরে দিনে দু’বার দাঁত মাজা এবং কিছু খেয়ে কুলকুচি বা জল খাওয়ার অভ্যেস করানো প্রয়োজন। শিশুরা নিজে দাঁত মাজা শুরু করলে তা ঠিক ভাবে করছে কি না নজর রাখতে হবে বড় কাউকে। মাউথওয়াশ নয়, টুথপেস্টের ব্যবহার জরুরি। পারমিতা জানাচ্ছেন, নিয়মিত যত্নেই দাঁতের ৯০ শতাংশ সমস্যা এড়ানো যেতে পারে।
চিকিৎসকের কাছে কখন যাবেন?
যত্ন সত্ত্বেও ছোট বয়সে সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। দুধের দাঁত পড়ে যাবে ভেবে কোনও সমস্যা অবহেলা করলে শিশুটি যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হবে। স্থায়ী দাঁতে ক্যাভিটির মতো সমস্যায় বড়দের মতোই চিকিৎসার প্রয়োজন। পেডিয়াট্রিক দন্ত চিকিৎসকের সন্ধান পেলে আরও ভাল। এ ছাড়া, দাঁতের মাঝে ফাঁক, এলোমেলো দাঁত বেরোনো, একটার উপরে আর একটা দাঁত, এলোমেলো মাড়ির মতো সব সমস্যারই চিকিৎসা প্রয়োজন। দাঁত বেরোনোর সময়ে যাতে গড়ন ঠিক থাকে, তার জন্য সেই সময় থেকে বোতলে খাওয়ানো বন্ধ করার পরামর্শ দিচ্ছেন পারমিতা। পাশাপাশি, আঙুল বা পেনসিল মুখে দেওয়ার মতো অভ্যাস শিশুর তৈরি হলে তা অবশ্যই ছাড়াতে হবে। না হলে সামনের দাঁত বেঁকে বা উঁচু হয়ে যেতে পারে। বাড়িতে বুঝিয়ে সমাধান না হলে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করতে পারেন দন্ত চিকিৎসক বা হ্যাবিট ব্রেকিং অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন।
মনে রাখতে হবে, দাঁত থাকতেই দাঁতের মর্ম বুঝতে হবে। আর সেই সচেতনতা শুরু হোক ছোট থেকেই।