doctor

Patient: রোগী গুরুতর  অসুস্থ হলেও হাসপাতালে না নিয়ে গেলে দায় কার?

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একটি বাচ্চাকে দেখতে রাত দুটোয় সন্তোষপুরে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙেছিল একপাল কুকুর।

Advertisement

অপূর্ব ঘোষ (চিকিৎসক)

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২২ ০৫:৪২
Share:

প্রতীকী ছবি।

বছর পঁয়ত্রিশ আগের কথা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একটি বাচ্চাকে দেখতে রাত দুটোয় সন্তোষপুরে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙেছিল একপাল কুকুর। সত্যি বলতে কী, তখন মানুষকে ভয় পেতাম না। আমার মতোই অনেকের প্রেরণা ছিলেন ‘অগ্নীশ্বর’ সিনেমার সেই আদর্শ চিকিৎসক অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায়। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষক বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকায় সেই চরিত্র রূপায়ণের বহু আগেই অবশ্য সিনেমায় দেখা মিলত রোগীর বাড়িতে অস্টিন চেপে, সাইকেলে বা হেঁটে আসা ডাক্তারের। বহু বার রোগীর নাড়ি ধরেই মৃত্যু ঘোষণা অথবা অসহায় চিকিৎসকের সামনেই রোগীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ ফুটে উঠত পর্দায়। কান্নায় ভারী বাতাস। তবুও সৌজন্য দেখাতে ভুলতেন না পরিজনদের কেউ এক জন। ডাক্তারকে দরজায় এগিয়ে দিয়ে হাতজোড় করতেন তাঁকে।

Advertisement

সিনেমার মতো সেই দৃশ্য বাস্তবে হয় কি? বেলঘরিয়ার নিমতার চিকিৎসক গৌরব রায় ও তাঁর পরিবারকে তা হলে রোগীর পরিজন আর প্রতিবেশীদের হাতে প্রহৃত হতে হত না। এর পরেও কি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার প্রথা থাকা উচিত? মাঝের এই তিন-চার দশকে বদলেছে সমাজ, বদলে গিয়েছে মানুষের চরিত্র। মানুষের একটা বড় অংশ যুক্তির ধার ধারেন না। তাঁদের চাহিদার প্রাসঙ্গিকতা বোঝাবে কে? কারণ, বোঝানোর মানুষগুলোই উধাও। সবাই শুধুই তাতিয়ে চলেছেন।

পেশায় ডাক্তার হওয়ায় জানি যে, রোগী যখন ‘সিরিয়াস’ অবস্থায় থাকেন, তখন তাঁর জন্য বিশেষ ওষুধ, ইঞ্জেকশন, স্যালাইন, অক্সিজেন বা আরও বেশি কিছু সাপোর্ট সিস্টেমের প্রয়োজন। চিকিৎসক বাড়িতে কি সে সব নিয়ে বসে থাকেন? অতএব তাঁকে বাড়িতে ডাকা মানে মূল্যবান সময় নষ্ট করা। কারণ, তিনি হয়তো রোগীকে দেখে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শই দেবেন। তখন? অর্থাৎ, প্রথমেই রোগীকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে জরুরি পরিষেবার জন্য নিয়ে গেলে তাঁর ভাল হওয়ার সুযোগ বেশি থাকত। সে ক্ষেত্রে এই দেরির খেসারত হয়তো পথেই দিতে হবে রোগীকে। ভাবুন, রোগী গুরুতর অসুস্থ হলেও হাসপাতালে না নিয়ে গেলে দায় কার? আসলে সময়টা নষ্ট করলেন কারা? চিকিৎসকের উপরে দোষ চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব কি ঝেড়ে ফেলা যায়?

Advertisement

গত তিন-চার দশকে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বদল এসেছে। সরকারি হাসপাতালের জরুরি পরিষেবার উন্নতি হয়েছে। নার্সিংহোম, বেসরকারি হাসপাতাল, কর্পোরেট হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। যেখানে আপনি গেলে দ্রুত চিকিৎসা পেতে পারেন। অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়াও আগের থেকে সহজ। অন্য ভাবেও রোগীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে এ সবই বলছি শহরকেন্দ্রিক বা শহরের উপকণ্ঠে থাকা মানুষের জন্য। গ্রামে এখনও বেঁচে অগ্নীশ্বরেরা। সেখানে আজও সৌজন্য অক্ষত বলেই হয়তো এই বেঁচে থাকা।

ডাক্তার তো আপনার মতোই মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই ২৪ ঘণ্টা এপ্রন পরে, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে থাকেন না। তাঁকে যখন রোগীর বাড়ির লোক ডাকছেন, তখন হয়তো তিনি শৌচাগারে আছেন। সেখান থেকে বেরিয়ে তৈরি হতে তাঁর সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। সেই ধৈর্য কেন থাকবে না? অথচ বিদেশে ইমার্জেন্সির ওয়েটিং লিস্ট কেমন, সেটা জানলে বোঝা যাবে, আমরা কতটা দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে থাকি। তবু সেখানে ভাঙচুর বা মারধরের ঘটনা কখনও শোনাই যায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সময় পেতে তিন-চার মাস অপেক্ষা বিদেশে স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রোগী দেখাটা ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার ভিত্তিতেও হয় না। এমন প্রথার দাবিও করতে পারে না সে দেশের রোগীর পরিবার।

প্রশ্ন হল, কেন কোনও ডাক্তার রোগীর বাড়ি যাবেন? যদি রোগীর কিছু ঘটলে ডাক্তার বা তাঁর পরিবারের জীবন সংশয় হয়?
বাড়িতে ডাকার এই প্রবণতায় অন্য বিপদও দেখেছেন অনেক ডাক্তার। এমনও ঘটেছে, ইতিমধ্যেই মৃত কারও চিকিৎসার নাম করে ডেকে আনা হয়েছে ডাক্তারকে। তাঁকে রীতিমতো বন্দুক দেখিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট আদায় করা হয়েছে। এর পরে হয়তো সেই ঘটনায় খুনের অভিযোগের মামলা দায়ের হয়েছে। আর ডাক্তারকে কোর্ট তলব করেছে। সম্মান, নিরাপত্তা এবং সামাজিক পরিচিতি হারাতে ভয় পাই সকলেই। আজকের দিনে তাই বার বার প্রশ্ন ওঠে, কেন যাব এমন জায়গায়, যেখানে সব খোয়ানোর ভয় লুকিয়ে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement