প্রতীকী ছবি।
ইদানীং অধূমপায়ী মহিলাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এদের বাবা, দাদা, স্বামী, শ্বশুর, স্বামী— প্রায় সকলেই ধূমপায়ী। প্যাসিভ ও সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিং এদের ক্যানসারের জন্য দায়ী। আসলে, ধূমপায়ীরা সিগারেটের ধোঁয়া টেনে নিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু যাঁরা ধূমপান করেন না, তাঁরা ধোঁয়া বের করে দিতে অপারগ। আর ঠিক এই কারণেই প্রতি বছর ৮ লক্ষ ৯০ হাজার মানুষ সিগারেট না টেনেও মারা যান। কার্বন মনোক্সাইড, নিকোটিন টার-সহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল নন স্মোকারদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসের পৌঁছে যায়।
এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে ১৯৮৭ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) উদ্যোগে ৩১ মে ‘নো টোব্যাকো ডে’ পালন শুরু হয়। এ বারের ৩৩তম তামাক বিরোধী দিবসের থিম ‘টোব্যাকো অ্যান্ড লাং হেলথ’। সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। দেখা গিয়েছে, সিগারেটের ধোঁয়া দু’ভাবে এক জন নন স্মোকারের শ্বাসনালী ও ফুসফুসে পৌঁছে যায়। সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছাড়া হলে তা যখন অন্য জন বাতাসের সঙ্গে টেনে নেয়, তাকে বলে মেন স্ট্রিম। আর সিগারেট জ্বালিয়ে রাখা আছে, তার থেকে ধোঁয়া সরাসরি বাতাসের সঙ্গে টেনে নিচ্ছে, তাকে বলে সাইড স্ট্রিম। এই ধোঁয়ায় আরও বেশি কার্সিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যানসার উৎপাদনকারী বিষাক্ত রাসায়ানিক থাকে। অত্যন্ত ক্ষতিকর এই ধোঁয়া বড়দের জন্য তো বটেই, ছোটদেরও ভয়ানক শারীরিক ক্ষতি করে। হবু মায়ের সামনে কেউ ধূমপান করলে তার থেকেও গর্ভস্থ ভ্রূণ ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর গর্ভবতী মা ধূমপায়ী হলে তো কথাই নেই। এক দিকে তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি যায় থেমে, অন্য দিকে নির্ধারিত সময়ের আগে শিশুর জন্ম হতে পারে। গর্ভস্থ ভ্রূণের মারা যাওয়ার ঝুঁকিও খুব বেশি থাকে। ধূমপায়ীর নিজের তো বটেই, সদ্যোজাত শিশুরও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। শিশুদের শ্বাসনালী বড়দের তুলনায় সরু ও ছোট। বাড়ির বড়দের ছেড়ে দেওয়া বিষ ধোঁয়া ওরা বুক ভরে টেনে নেয়। এর ফলে শ্বাসনালী আর ফুসফুস ‘ইরিটেটেড’ হয়ে পড়ে। এর ফলে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে ক্রনিক সর্দিকাশি, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যে সব শিশুর অ্যাজমা আছে, তামাকের ধোঁয়ায় তাদের বারে বারে অ্যাটাক হয়। নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার এক ধূমপায়ী তরুণ ব্রায়ান কার্টিসের ঘটনা সকলের জেনে রাখা উচিত। না, উনি কোনও খ্যাতনামা অ্যাথলিট বা বিজ্ঞানী নন। ১৯৯৯ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। অসুখ ধরা পড়ার পরই ব্রায়ান কার্টিস ধূমপানের ভয়াবাহতার কথা উপলব্ধি করেন। তখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। ব্রায়ান ও তাঁর মা দু’জনে মিলে ধূমপানের ভয়ানক দিক সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে সরকারের সাহায্য চান। তাঁর মা ছিলেন ধূমপায়ী, আর ব্রায়ান ১৩ বছর বয়স থেকে সিগারেট ফুঁকতে শুরু করেন। দিনে ২০টিরও বেশি সিগার ছাড়া ওঁর চলত না। ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ার মাত্র ১০ সপ্তাহের মধ্যে ৩৩ বছরের ব্রায়ান কার্টিস মারা যান। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিগারেটের প্যাকেটে তাঁর ছবি ব্যবহার করেন। ও দেশে ধূমপানের হার গত ২০ বছরে অনেক কমেছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যের শহুরে তরুণ তরুণীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বাড়ছে। রাস্তাঘাটে, পার্কে যেখানে পারে সেখানেই সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে অসুবিধে সৃষ্টি করে পথচলতি মানুষজনের।
আরও পড়ুন: সিগারেটে আসক্তি? ক্যানসার বা হার্টের অসুখ ছাড়াও রয়েছে এ সব ভয়
সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনকেও ধূমপান বিরোধিতায় সোচ্চার হতে হবে। এই সংক্রান্ত কঠোর আইন জারি করার সঙ্গে সঙ্গে যে সব আইন ইতিমধ্যে চালু আছে সেগুলির প্রয়োগে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্কুলের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও সিগারেট বিড়ির দোকান থাকলে তা বন্ধ করে দিতে হবে। প্রকাশ্য জায়গায় তো বটেই, রাস্তাঘাটে ধূমপান বন্ধ করা জরুরি। কেরল ও তামিলনাড়ুতে আইন করে প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ করা গিয়েছে। পাশের রাজ্য বিহারেও একই আইন জারি করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এ ব্যাপারে সহস্র যোজন দূরে। বিশ্ব ধূমপান বিরোধী দিবসে ধূমপায়ীদের লাগাতার ও নাছোড় কাউন্সেলিং করে ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করার শপথ নিতে হবে কাছের মানুষদের।