থোড়াই কেয়ার: শহরের সংক্রমণ-চিত্র ভীতিপ্রদ হলেও ছেদ নেই মাস্কহীন আড্ডায়। শুক্রবার, টালিগঞ্জে। নিজস্ব চিত্র।
অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সারা দেশে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, এমন রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। মৃত্যু হয়েছে ৪.৮৩ লক্ষ মানুষের। কিন্তু এই সংক্রমণ, মৃত্যু ঠেকানো যেত শুধুমাত্র মাস্ক পরে এবং দূরত্ব বজায় রাখলে। অথচ, সেটাই করে ওঠা গেল না। যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা! কারণ, সার্স-কোভ-২ সংক্রমিত রোগীর হাঁচি-কাশির সঙ্গে বেরোনো ড্রপলেটের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে মুখ, নাক, চোখ দিয়ে। ‘‘ফলে সেই প্রবেশপথই বন্ধ করে দিলে এবং সংক্রমিতের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশই করতে পারত না। অর্থাৎ, রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট পর্যন্ত পৌঁছতেই পারত না ভাইরাস। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ বা মৃত্যু হত কী ভাবে?’’, বলছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া রিজিয়ন অফিসের ‘কমিউনিকেবল ডিজ়িজ়’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা রাজেশ ভাটিয়া।
অথচ আক্ষেপ, সেই দুটো কাজই করা গেল না, বলছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এক সংক্রামক রোগের চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সব সংক্রমণ বা সব মৃত্যু হয়তো আটকানো যেত না। কিন্তু সিংহভাগই যে যেত, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। শুধুমাত্র পরিস্থিতি লঘু করে দেখার খেসারত দিতে হচ্ছে জীবন দিয়ে। এ যেন নিজের মৃত্যুর শংসাপত্র আমরা নিজেই লিখলাম!’’ এ ক্ষেত্রে অনেকে অবশ্য কো-মর্বিডিটির তত্ত্ব তুলে ধরছেন। তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্যই বলছে, দেশের মোট মৃতের মধ্যে ৭০ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে কো-মর্বিডিটির কারণে। কিন্তু সেখানেও এই প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে, করোনাভাইরাস শরীরে ঢুকতে পেরেছে বলেই অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার ফল প্রাণহানি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শদাতা তথা ‘সেন্টার ফর ডিজ়িজ়, ডায়নামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি’র অধিকর্তা রামানন লক্ষ্ণীনারায়ণ জানাচ্ছেন, সব না হলেও এন-৯৫ মাস্ক ঠিক ভাবে পরলে অনেক কেস এবং মৃত্যুই ঠেকানো যেত। কিন্তু সমস্যা হল, সেটাই করছেন না সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা মাস্ক পরছেন, তাঁরাও বেশির ভাগ কাপড়ের মাস্ক পরছেন, যা ওমিক্রনের মতো সংক্রামক স্ট্রেনের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে আমরা দেখেছি, কী ভাবে প্রতি পদে কোভিড-বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ বার অন্তত জনস্বাস্থ্য বিপন্ন করে সমাবেশ, মিছিল, উৎসব— এ সমস্ত বন্ধ হোক!’’
কিন্তু তা শুনছে কে? শুরু থেকে বিশেষজ্ঞেরা পইপই করে যা যা বলে এসেছেন, সেগুলির সিকিভাগও পালন করা গেলে এত মৃত্যু, এই দিশাহারা অবস্থা যে তৈরি হত না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত অনেকেই। ‘‘বিপদ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা তাকে যেন নেমন্তন্ন করে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলাম। এখন সব সময়ে আতঙ্কে ভুগছি।’’— বলছেন শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের এক চিকিৎসক। আরও একটি প্রবণতার কথা তুলে ধরছেন বিশেষজ্ঞেরা। তা হল, যে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নিয়ম পালন করে সংক্রমণ প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর গোষ্ঠী, পুলিশ-প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায়। এক মাইক্রোবায়োলজিস্ট ক্ষোভের সুরে জানাচ্ছেন, কেউ সংক্রমিত হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করলে, অর্থাৎ মাস্ক না পরলে অথবা দূরত্ব-বিধি না মানলে এবং সেই কারণে অন্যেরা সংক্রমিত হলে তার দায়িত্ব কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপরে বর্তাবে না? ওই মাইক্রোবায়োলজিস্টের কথায়, ‘‘এ বার সেই সংক্রমিতদের মধ্যে কারও মৃত্যু হলে আমি কি সেই অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকব না? সে ক্ষেত্রে আমার শাস্তি হবে না? তখনও মাস্ক পরুন, এই জাতীয় অনুরোধ-উপরোধ করে চলবে পুলিশ-প্রশাসন? জীবনের চেয়ে অনুরোধ-উপরোধের দাম বেশি হল?’’