রুগ্ন নবজাতকের চিকিৎসায় রাজ্য জুড়ে সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট খোলা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হারও বাড়ছে যথেষ্ট দ্রুতই। তার পরেও হাসপাতালে জন্মানো শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমছে না কেন? শহর এবং জেলার হাসপাতালগুলিতে এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা হতবাক। তাঁরা দেখছেন পরিকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও বহু শিশু জন্মের সময়ে শ্বাসকষ্টে (বার্থ অ্যাসপেক্সিয়া) মারা যাচ্ছে। আর বহু ক্ষেত্রেই এর মূলে রয়েছে মিসোপ্রোস্টল নামে একটা ওষুধ। তার যথেচ্ছ ব্যবহারই বহু নবজাতকের মৃত্যু ডেকে আনছে।
শনিবার স্বাস্থ্য ভবনে এ নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সমস্ত হাসপাতালের সুপার এবং স্ত্রী রোগ বিভাগের প্রধানদের ওই বৈঠকে ডাকা হয়েছে। মিসোপ্রোস্টলের ব্যবহার সম্পর্কে ওই বৈঠকে ফের সকলকে সতর্ক করা হবে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, এই ওষুধটির অপপ্রয়োগে বহু শিশুর মৃত্যু হতে পারে। জরায়ু ফেটে গিয়ে মৃত্যু হতে পারে মায়েদেরও। আর সে ব্যাপারে একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশও জারি হয়েছে কয়েক দফায়। কিন্তু তার পরেও বিষয়টি ঠেকানো যাচ্ছে না।
রাজ্যে বছরে ৪৬ হাজারের মতো নবজাতকের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৭-১৮ হাজার নবজাতক মারা যায় সরকারি হাসপাতালে। স্বাস্থ্য দফতরের নিজস্ব সমীক্ষাই জানাচ্ছে, এই ১৭-১৮ হাজারের মধ্যে ৬০ শতাংশই মারা যায় শ্বাসকষ্টে। আর শ্বাসকষ্টের অন্যতম একটি কারণ হল মিসোপ্রোস্টলের ব্যবহার। বহু ক্ষেত্রে আবার মৃত্যু না হলেও বার্থ অ্যাসপেক্সিয়ার জন্য শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ধাক্কা খায়, এমন কী সে জড়বুদ্ধিও হয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গোড়ায় গ্যাসট্রিক আলসারের চিকিৎসার জন্য ওই ওষুধটির ব্যবহার ব্যবহার শুরু হয়। পরে দেখা যায়, এই ওষুধ জরায়ু সঙ্কোচনেও সাহায্য করে। তখনই চিকিৎসকেরা গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ওষুধটির ব্যবহার শুরু করেন। ‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি’র জন্য এই ওষুধের ব্যবহার এখন বহুল প্রচলিত। পাশাপাশি, জরায়ু সঙ্কোচন-প্রসারণ দ্রুত হলে গর্ভস্থ সন্তান যেহেতু দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে, সেই কারণে চিকিৎসকদের একাংশ স্বাভাবিক প্রসবের জন্যও এর ব্যবহার শুরু করে দেন। প্রসব বেদনা শুরু না হলে মিসোপ্রোস্টল দিয়ে ব্যথা তোলার অভ্যাস বেশির ভাগ হাসপাতালেই রয়েছে। কিন্তু নিয়ম হল, কোনও জরুরি পরিস্থিতিতে যদি মিসোপ্রোস্টল দিতেও হয়, তা হলে মায়ের উপরে টানা নজর রেখে যেতে হবে। প্রসবের জন্য সংশ্লিষ্ট মহিলার শরীর সব দিক থেকে প্রস্তুত না হওয়া সত্ত্বেও এই ওষুধ প্রয়োগ করলে তার ফল মারাত্মক হতে পারে। বস্তুত, সেটাই ঘটছে।
স্ত্রী রোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই ওষুধ প্রয়োগ করলে শিশুরা দ্রুত ধড়ফড় করে বেরিয়ে আসে। ফলে জন্মের সময়ে অক্সিজেন পায় না। ‘বার্থ অ্যাসপেক্সিয়া’ নিয়ে জন্মায়।” সবচেয়ে বিপজ্জনক হল এই ওষুধের ডোজ। তিনি বলেন, “ওষুধটি কোনও ভাবেই ২৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি দেওয়া চলে না। অর্থাৎ বাজারে যে ট্যাবলেট পাওয়া যায়, তার চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এটা মানা হয় না। বেশি ডোজ দিয়ে তাড়াতাড়ি প্রসব করাতে গিয়ে মা এবং শিশু, দু’জনেরই মৃত্যু ডেকে আনা হয়। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কী হতে পারে? শুধু জেলা হাসপাতাল নয়, কলকাতাতেও মিসোপ্রোস্টলের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে।”
রাজ্য জুড়ে মা ও নবজাতকের মৃত্যু হার কমাতে টাস্ক ফোর্স তৈরি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ও স্বীকার করে নিয়েছেন, এই ওষুধের ব্যবহার বন্ধ হলে নবজাতকের মৃত্যুহার আরও অনেকটাই কমানো যেত। তাঁর কথায়, “ওই ওষুধ শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। বার বার সতর্ক করার পরেও এক শ্রেণির চিকিৎসক তা শুনছেন না। এ বার এটা রুখতে আরও কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রমাণিত হলে সেই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভাগীয় প্রধানদেরও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে।”
ঝুঁকির কথা জেনেও কেন আসন্ন প্রসবাকে মিসোপ্রোস্টল দেন ডাক্তারেরা? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এর উত্তরটাও আমরা জানি। ডাক্তাররা চান, প্রসব তাড়াতাড়ি হোক। বহু জেলায়, এমনকী কলকাতার হাসপাতালেও ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ডাক্তারদের বাড়ি যাওয়ার কিংবা চেম্বারে পৌঁছনোর তাড়া রয়েছে। তাঁরা চান দ্রুত ব্যথা উঠুক। তাই বহু ক্ষেত্রেই কাউকে কিছু না জানিয়ে, এমনকী রেকর্ড না রেখেই মিসোপ্রোস্টল দেন।”