পার্কে গিয়ে মায়ের হাত ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে রাতুল। পাঁচটা বাচ্চা একসঙ্গে খেললেও সে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলতে পারে না।
চিনি আবার ছুটিছাটার দিনে খেলতে যায় ঠিকই। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই তাকে কেউ খেলায় নিচ্ছে না বলে সে বাড়ি ফিরে আসে।
সন্তানের বন্ধু হচ্ছে না বা কোনও বৃত্তেই সে ঠিক মতো মিশতে পারছে না, স্কুল হোক বা পাড়া সব দলেই যেন সন্তান ব্রাত্য। এমন সমস্যা নিয়ে অনেক অভিভাবকই চিন্তিত। কোনও সময়ে হয়তো সন্তান কষ্ট পাবে ভেবে তাঁরা সন্তানকে ঘরেই ব্যস্ত রাখেন। কোনও সময়ে আবার নিজেরাই চলে যান মধ্যস্থতা করতে। এগুলোর কোনওটাই ঠিক পদক্ষেপ নয়। তবে সন্তান যেন বন্ধুবৃত্তে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারে তার জন্য কিছু করণীয় আছে অভিভাবকেরও।
যা-যা করবেন
- প্রথমেই মনে রাখতে হবে, এখন বেশির ভাগ বাচ্চাই একা বড় হচ্ছে। পরিবার বলতে মা-বাবা আর সে। অনেকেরই ভাই বা বোন থাকে না। ফলে মতের অমিলেও মানিয়ে নিতে বা কোনও একটা জিনিস ভাগ করে নিতে অভ্যস্ত নয় তারা। তাই ধীরে ধীরে তাকে সমাজে বাকিদের সঙ্গে মিশতে শেখাতে হবে।
- সন্তানকে তার বন্ধুদের সঙ্গে ছাড়তে হবে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, “অনেক সময়েই মা-বাবারা বিভিন্ন কারণে কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিশতে দেন না। বিশেষত বুলির ভয়ে বাঙালি অভিভাবকরা সন্তানকে আটকে রাখেন। কোনও বন্ধুবৃত্তে যদি মানসিক পীড়া দেওয়া হয়, তাই সেখান থেকে সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখেন। সেটা না করে বরং ওকে মিশতে দিন। ওকেই লড়তে দিন ওর সমস্যায়। দরকারে সন্তানকে শেখাতে পারেন, কী ভাবে সে পরিস্থিতি সামলাবে বা উত্তর দেবে। কী ভাবে সেই বন্ধুবৃত্তে সে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।”
- অকারণে স্কুল কামাই-ও চলবে না বলে মত পায়েলের। স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত, আরও পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে-চলতে সে-ও বহির্জগতে মিশতে শিখবে। স্কুলে সন্তানের বন্ধুবান্ধব তৈরি হচ্ছে কি না সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে অভিভাবককে। “মাঝেমাঝে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে প্লে-ডেট ঠিক করে দিতে পারেন অভিভাবকরা। কোনও পার্কে বা মেলায় হয়তো নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে বাচ্চা আপনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও আবার নিয়ে যান। হয়তো প্রথম কিছুদিন সে আলাদা দাঁড়িয়ে থাকবে, কিন্তু একটা সময়ে সে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলবে।” তবে নিজে ওর বন্ধু ঠিক করে দেবেন না। ওকেই বেছে নিতে দিন ওর বন্ধু।
- অনেক সময়ে আবার দেখা যায়, সন্তানের পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে বন্ধুদের মিলছে না, ফলে সে খেলতে গিয়েও ফিরে আসছে। পায়েলের কথায়, “হয়তো বাচ্চাটি খেলতে গিয়ে তার মতের সঙ্গে মিল হচ্ছে না বলে ফিরে এসে নালিশ করছে। তখন কিছু অভিভাবক মধ্যস্থতা করতে যান। অনেকে আবার বাচ্চাটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। সন্তানের মনখারাপ হবে ভেবে নিজেই খেলতে শুরু করেন বা তাকে একা খেলার উপদেশ দেন। এর কোনওটাই ঠিক নয়। বাচ্চা যদি খেলতে না পেরে, কারও সঙ্গে মিশতে না পেরে ফিরে আসে, তাকে সেই কষ্টযাপন করার সময়টা দিতে হবে। তবেই সে ভাববে যে, সে কেনও খেলতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা সেটা মধ্যস্থতা করে মিটিয়ে দিলে তার নিজের উদ্যোগে কিছু করতে হচ্ছে না। ফলে তার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি তৈরি হবে না। সে কিছু হলেই এসে মা-বাবাকে বলবে।” তার চেয়ে বরং তাকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘সে কেন খেলতে পারছে না?’ তার দিকে কোনও সমস্যা আছে কি না তাকে ভাবতে দিন। পায়েলের পরামর্শ, মা-বাবা যে তার বন্ধু নয়, সন্তানকে সেটা স্পষ্ট বলতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, মা-বাবার আলাদা বন্ধুবৃত্ত আছে আর তাকেও তার বন্ধুবৃত্ত তৈরি করতে হবে। ধীরে ধীরে সে-ও তখন অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলতে শিখবে।
- সন্তানকে সামাজিক করে তোলা একটা কাজ। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে কী বলবে, বন্ধুর দরকারে কী ভাবে পাশে থাকবে, দরকারে ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে তাকে উদাহরণ দিতে হবে। সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার চেয়ে এই গল্পের প্রভাব বেশি পড়ে।
- একটু বড় বাচ্চাদের মধ্যে আবার আর-এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। তার হয়তো একটিই ভাল বন্ধু। তার বাইরে সে কারও সঙ্গে মিশছে না। সেই একটি বন্ধুই যা করে বা বলে, সেটাই তার জীবনের ধ্রুবসত্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা অনেক সময়েই সেই বন্ধুটির নাম নিয়েই হয়তো সন্তানকে বাক্যবাণে আক্রমণ করেন। সেটা একদম চলবে না। তার বন্ধু তার জন্য মূল্যবান। বরং অভিভাবক হিসেবে সন্তানের মেলামেশার পরিসর বাড়াতে হবে। গান, আঁকা, সাঁতার ইত্যাদি নতুন ক্লাসে ভর্তি করতে পারেন, যেখানে তার আরও বন্ধু তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তার প্রাণের বন্ধুটিও রইল, নতুন বন্ধুও তৈরি হল।
কী করবেন না
- বন্ধুদের মাঝে ঢুকে বাচ্চার হয়ে মধ্যস্থতা করবেন না। কারও পক্ষ নেবেন না। তবে শারীরিক আক্রমণ হলে আলাদা কথা। সে ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
- সন্তানের হয়ে বন্ধু নির্বাচন করে দেবেন না। তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝান বন্ধু আসলে কেমন হয়। দেখবেন, সে নিজেই ভাল-মন্দের বিচার করতে শিখবে।
- নিজের সন্তানের জন্য অন্য বাচ্চাদের আঘাত করবেন না।
মনে রাখবেন, প্রত্যেক শিশু আলাদা। অনেকে বাইরে দারুণ মিশতে পারে, তাদের সঙ্গে তুলনা টানলে চলবে না। সন্তানকে তার মতো করেই মিশতে দিন। বহির্জগতে সারা জীবন কিন্তু সন্তানকে একাই চলতে হবে। তার লড়াই তাকেই লড়তে হবে। সেখানে অভিভাবকের ভূমিকা নেপথ্যে। তাই ছোট থেকেই নেপথ্যের ভূমিকাটা যথাযথ পালন করলে সন্তান ঠিক তার ইচ্ছেডানা মেলতে পারবে বহির্জগতে। সেখানে বন্ধুও হবে, আবার কোথাও আঘাত পেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেও শিখবে। কে বন্ধু আর কে নয়, সেটাও চিনতে শিখবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)