অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন দিব্যা স্যামন পানাবকম। ২০১৩ সালে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। যেদিন জানতে পারেন সন্তানের আগমনের কথা তাঁর একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যু হয়। এক মাস পরে গর্ভপাত হয়ে যায় তাঁর। সন্তান হারানোর সেই পর্যায়টিও দিব্যার পক্ষে মারাত্মক হয়েছিল। রক্তপাত শুরু হয়েছিল। একাই গিয়েছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের কর্মীরা ভেবেছিলেন, তিনি অবিবাহিতা। তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। পরে বলা হয়, কুকুরের থেকে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে তাঁর। কিন্তু ২০১৬ সালে জানা যায়, তাঁকে রুবেলা ভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই টিকাকরণ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
বিশ্ব জুড়ে মেয়েদের গর্ভপাত নিয়ে এমন নানা খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। গর্ভপাত নিয়ে চিন্তিত বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রকও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও উদ্বিগ্ন (হু)। কারণ বিশ্বে জন্মের আগেই সন্তান হারানো মায়েদের সংখ্যা কম নয়। মা এবং শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের পরিসংখ্যান দিয়েছে হু। ওই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন এমন ভাবী মায়েদের ১০-১৫ শতাংশ গর্ভপাতের কষ্ট ভোগ করেন। বাংলায় গর্ভপাত বলা হলেও চিকিৎসকেরা এমন বিপর্যয়কে দু’টি ভাগে ভাগ করেছেন। সাধারণ ভাবে গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাহের আগে সন্তান হারালে ‘মিসক্যারেজ’ বলা হয়। কিন্তু গর্ভস্থ সন্তান গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাব বা তার পরে মারা গেলে বলা হয় ‘স্টিলবার্থ’। বাংলায় দু’টো বিপর্যয়ই গর্ভপাত।
প্রতি বছর বিশ্বে ‘স্টিলবার্থ’ শিশুর সংখ্যা ২৬ লক্ষ। তবে এটাও ঠিক, ‘মিসক্যারেজ’ এবং ‘স্টিলবর্ন’এর পরিসংখ্যান পদ্ধতিগত ভাবে নথিভুক্ত করা হয় না। তাই এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও এই সংখ্যা উদ্বেগজনক। ‘স্টিলবার্থ’এর ঘটনা বেশি ঘটে প্রসবের সময়ে। হিসেব বলছে, প্রতি দু’টি ‘স্টিলবার্থ’এর একটি ঘটে প্রসবের সময়ে। নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোয় ‘স্টিলবার্থ’এর ৯৮ শতাংশ ঘটে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গর্ভাবস্থায় সন্তান হারানো আটকানো যায় বলে জানাচ্ছে হু। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, গর্ভপাত মানে শুধু সন্তান হারানো নয়। সন্তান হারানো মায়েদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নানা সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোয় এই সমস্যা প্রচুর। এই চাপ কাটিয়ে ওঠা কারও পক্ষে বেদনার হয়ে ওঠে। কেউ আবার সন্তান হারানোর দুঃখে মানসিক চাপে পড়ে যান ভীষণ। সেই চাপ কাটাতে কয়েক বছর লেগে যায়। এমনও দেখা গিয়েছে, গর্ভপাত হওয়া মা পরে এক সুস্থ সন্তানের জননী। কিন্তু গর্ভাবস্থায় হারানো সন্তানের দুঃখ তখনও তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
কেন গর্ভপাত হয়? এর অনেক কারণ। ভ্রূণের কোনও অস্বাভাবিকতা থাকলে গর্ভপাত হতে পারে। এ ছাড়া মায়ের বয়স একটি বড় কারণ। বাল্যবিবাহের ফলে মা হওয়া মেয়েদের গর্ভাবস্থায় সন্তান হারানোর সম্ভাবনা খুবই বেশি। বাল্যবিবাহ এমনিতেই মেয়েদের যৌন এবং সন্তানধারণের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। কম বয়সে মা হওয়া শুধু নিজের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। সন্তানের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ভয়ঙ্কর। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, কম বয়সি মায়েদের মূত্রনালীতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ২০-২৪ বছরের মায়েদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা অনেক কম। কম বয়সি মায়েদের সন্তানের স্বাস্থ্যও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেখা গিয়েছে, ২০ বছরের কম বয়সি মায়েদের সন্তানেরা কম ওজনের হয়ে থাকে। জন্মাতে পারে সময়ের আগে। এ ছাড়াও নানা সমস্যায় ভুগতে পারে।
অনেক সময়ে সংক্রমণের কারণেও গর্ভপাত হয়। চিকিৎসকেরা গর্ভপাত আটকাতে সাধারণ ভাবে কয়েকটি নিদান দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে অন্তঃসত্ত্বাদের। ব্যায়াম করতে হবে নিয়মিত। সেই সঙ্গে পরামর্শ দেওয়া হয়, অন্তঃসত্ত্বারা যেন ধূমপান না করেন। মাদক এবং মদ্যপান থেকে দূরে থাকেন। ক্যাফিন আছে এমন পানীয় নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় খান। গর্ভাবস্থায় আরেকটি বিষয়ের উপরে গুরুত্ব দিতে হয়। মানসিক চাপ এবং অবসাদে যেন ভাবী মা না ভোগেন। একই ভাবে সন্তান হারানোর পরে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, গর্ভাবস্থায় সন্তান হারানোর কথা অনেকেই জনসমক্ষে বলতে চান না। পরিবারের সদস্যরাও সে কথা পারতপক্ষে তোলেন না। যেন সামাজিক বিধিনিষেধ রয়েছে। অনেক সময়ে গর্ভপাত হওয়াকে লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই সমস্যা উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও একই রকম। গর্ভপাতের পরে মানসিক এবং ভাবে চাপে থাকেন এই পরিবারের সদস্যেরাও। তবে উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে চাপ কমানোর একটা সুবিধেও থাকে। অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সন্তান হারানোর বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা সেই বাধা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। তবে বিশেষজ্ঞেরাও মানছেন, অনেক সময়ে গর্ভপাত হওয়া কোনও পরিচিতকে সান্ত্বনা দেওয়া বেশ অস্বস্তির। ‘কী বলব’— এই সংকোচ কাটিয়ে ওঠা যায় না।
অনেক সময়ে দরিদ্র দেশগুলোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিষেবা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে অনেক সময়েই ঠিকঠাক পরিষেবা মেলে না। কারণ পরিকাঠামোর অভাব থাকে হাসপাতালগুলোতে। অনেক সময়ে কর্মীর সংখ্যাও থাকে কম। পশ্চিমবঙ্গে মায়ের স্বাস্থ্যরক্ষায় রয়েছে একাধিক প্রকল্প। আশাকর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাবী মায়েদের সাহায্য করে থাকেন। তাঁরা মায়ের স্বাস্থ্যরক্ষায় খাওয়াদাওয়া-সহ নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।