কাপড়, কাগজ, শোলা, পাট, বাঁশ, কাঠ, মোম দিয়ে তৈরি ফুল অন্দরের শোভা বাড়াবে। নিজস্ব চিত্র।
শোলার তৈরি জুঁই বা বেল ফুলের মালা হঠাৎ করে দেখলে আসল ফুলের সঙ্গে পার্থক্য করাই মুশকিল! অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে বাড়ির অন্দরমহল, কেশসজ্জা থেকে কনের হাতের ফুলের স্তবকে কৃত্রিম ফুলের জনপ্রিয়তা এখন বিশ্বজুড়ে। সিল্ক, সাটিন, কাগজ, বাঁশ, শোলা, পাট, কাঠ, মোম ইত্যাদি নানা ধরনের উপাদান দিয়ে শিল্পীরা তৈরি করেন কৃত্রিম ফুল। তাঁদের সৃষ্টি এতটাই নিখুঁত যে, অনেক সময়ে আসল-নকল বোঝা মুশকিল। আবার অনেক সময়ে ফুলের রং ও ডিজ়াইন তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পীরা তাঁদের কল্পনার আশ্রয় নিয়ে তা ফুটিয়ে তোলেন অনবদ্য ভাবে।
কৃত্রিম ফুল ব্যবহার কিন্তু হালের ঘটনা নয়। প্রায় ১৫০০ বছর আগে চিনের রাজপরিবারের মেয়েরা কেশসজ্জার জন্য রেশমের কাপড় দিয়ে তৈরি ফুলের ব্যবহার শুরু করেন। এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, ক্রমে তা রাজপ্রাসাদ সাজানোর জন্যও ব্যবহার হত। চিনের রেশম কাপড়ের ফুল বাণিজ্য পথের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল জাপান ও কোরিয়ায়। এর পরে ইটালি, ফ্রান্সের মাধ্যমে কৃত্রিম ফুলের ব্যবহার শুরু হয় ইউরোপে। রেশমের কাপড়ের পাশাপাশি সাটিন, ভেলভেট, মসলিন, ক্রেপ ইত্যাদি উপাদানের কৃত্রিম ফুল জনপ্রিয় হয় ইউরোপে। ইংল্যান্ড থেকে বিস্তার পায় মার্কিন মুলুকে।
অনুষ্ঠানে গোটা বাড়ি আসল ফুল দিয়ে সাজাতে যে খরচ, তা অনেকটাই কম হয় কৃত্রিম ফুলের ব্যবহারে। ফলে এখন অধিকাংশ অনুষ্ঠানে ডেকরেশন করা হয় কৃত্রিম ফুল দিকে। এতে উপরি সুবিধে ঋতু অনুযায়ী ফুল নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই। ধরুন, আপনার পছন্দ পিওনি, টিউলিপ, লিলি, অর্কিড। কিন্তু ইচ্ছে হলেও এই সব ফুল হয়তো হাতের কাছে পাচ্ছেন না। পাওয়া গেলেও দাম আকাশছোঁয়া। তখন কাজ চলতে পারে কৃত্রিম পিওনি বা টিউলিপে। শুধু বিদেশি ফুল নয়, সূর্যমুখী, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, জুঁই, বেল ইত্যাদি ভিন্ন মরসুমের ফুল সারা বছর মেলে না। এই সমস্যা নেই কৃত্রিম ফুলে। মোটামুটি সব পরিচিত ফুলের রেপ্লিকা পাওয়া যায় বাজারে।
ফুলে অনেকেরই অ্যালার্জি থাকে। শুধু মানুষ নয়, বেশ কয়েক ধরনের গাছ ও ফুল বাড়ির পোষ্যদের জন্যও উপযুক্ত নয়। এ ছাড়া বাচ্চাদের হুড়োহুড়িতে জলভর্তি ফুলদানি পড়ে ছত্রখান হওয়ার ভয় তো থাকেই। এই ধরনের পরিস্থিতিতে গৃহসজ্জার জন্য উপযুক্ত কৃত্রিম ফুল।
কৃত্রিম ফুল কেনার সময়ে অবশ্যই জোর দেবেন পরিবেশবান্ধব উপাদানের উপরে, যেমন কাপড়, কাগজ, শোলা, পাট, বাঁশ, মাটি, কাঠ, মোম ইত্যাদি, যা আপনি বাতিল করলে পরিবেশ দূষিত হবে না। এড়িয়ে চলুন প্লাস্টিকের তৈরি ফুল। প্লাস্টিক পরিবেশরক্ষার পরিপন্থী। কৃত্রিম ফুল কেনার সময়ে খেয়াল করা উচিত তার শোভায় যেন আভিজাত্য থাকে। ফুল দিয়ে ঘর সাজানোর আগে মাথায় রাখতে হবে ঘরের আলো, দেওয়াল ও পর্দার রং। তাই কেনার আগে কোন ফুল কোন ঘরে মানাবে বা কেমন করে রাখলে তার রূপ ফুটবে তা ভেবে নিতে হবে। এক জায়গায় একটা বড় গুচ্ছ না তৈরি করে ছোট-ছোট করে ঘরের কোণে টেবিলে, জানালার পাশে, ফ্রিজের উপরে, ক্যাবিনেটের ভিতরে, খাটের পাশে ছোট্ট টেবলে বা বাথরুমেও রাখতে পারেন কৃত্রিম ফুল। জলের প্রয়োজন নেই। তাই বেতের ঝুড়ি, পাটের ব্যাগ, সেরামিকের কেটলি ইত্যাদি যেমন খুশি মানানসই পাত্রে রাখতে পারেন এই ফুল, এতে সৌন্দর্য বাড়ে। গুচ্ছ বাঁধার জন্য ব্যবহার করতে পারেন শৌখিন লেস, পাটের দড়ি, সাটিন ফিতে ইত্যাদি। বাড়ির সদর দরজায় নেমপ্লেটের পাশে ছোট হ্যাঙ্গিং পটে বা চুম্বক লাগানো কোনও ভাসের মধ্যে নানা রঙের কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজাতে পারেন। এমনকি উপহার দেওয়ার সময় গিফট বক্সের উপর জুড়ে দিতে পারে রেশম কাপড়ের ছোট ছোট গোলাপ বা পিওনি। পোশাকের সঙ্গে রং মিলিয়ে যে ফুল মাথায় লাগাতে চাইছেন তা হাতের কাছে না পেলে মুশকিলআসান কৃত্রিম ফুল। শুধু নিজের ঘর নয়, অফিসের টেবিল বা নিজের বুটিক বা শোরুম সুন্দর করে সাজাতে ব্যবহার করা যায় নানা রঙের কৃত্রিম ফুল। শোলা শিল্পী মল্লিকা হালদার বললেন, ‘‘শোলার তৈরি গোলাপ ফুলের তোড়া, বেল ফুল, ফুলের মালা খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। হল ডেকোরেশনের জন্য চাহিদা বাড়ছে। বিশেষত বিয়ের মরসুমে অন্য রাজ্য থেকে প্রচুর অর্ডার আসে। সাদা রঙের স্নিগ্ধতা, শোলার আভিজাত্য এবং ওজনে হালকা হওয়ায় দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। গোলাপের ক্ষেত্রে শোলার উপরে লাল, হলুদ রংও করা হচ্ছে।’’
আসল ফুলের মতো তরতাজা রাখার জন্য জল দিতে হয় না ঠিকই তবে এর সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য নিয়মিত ফুলের উপর পড়া ধুলো পরিষ্কার করতে হবে। বেশ কিছু উপাদানের তৈরি ফুল জল দিয়ে ধোয়া যায়। কিন্তু শোলা, কাগজের ফুলের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ধুলোপড়া মলিন ফুল ঘরে না রেখে মাঝে-মাঝে বদলে ফেলাই ভাল। কারণ একই জায়গায় একই রকমের কৃত্রিম ফুল দেখতে দেখতে একঘেয়েমি আসে। তা ছাড়া প্রয়োজনে আসল-নকল দু’রকমের ফুল মিলিয়ে মিশিয়ে ডেকরেশন করতে পারেন। কৃত্রিম ফুলের দাম খুব বেশি নয়, টেকসই, সৌন্দর্য ধরে রাখে দীর্ঘ দিন। তবে আসল ফুলের রং, গন্ধ এবং স্নিগ্ধতার কখনওই কোনও বিকল্প হয় না।