‘‘একলা থাকতে তো অভ্যস্তই হয়ে গিয়েছিলাম। কোনও অসুবিধা হত না। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। বিশ্বাস করুন, এতটা একা লাগেনি কখনও।’’― বলছিলেন বছর পঁয়ষট্টির সুকুমার মিত্র। শ্যামবাজারের বাসিন্দা
সুকুমারবাবুর স্ত্রী মারা গিয়েছেন চার বছর। মেয়ে বিবাহসূত্রে বিদেশে থাকেন। তাঁর বাড়ির কাজকর্ম দেখভালের জন্য পরিচারিকা রয়েছেন। বাজার করা, ব্যাঙ্কে যাওয়া, বাড়ির টুকটাক কাজ, বিকেলে হাঁটতে বেরোনো— এ সব নিয়ে সুকুমারবাবুর নিজস্ব রুটিন আছে। করোনা-হানায় বিপর্যস্ত সব কিছুই।
ফোনে বার বার বাইরে বেরোতে বারণ করেছেন মেয়ে। তাই এক রকম ঘরবন্দি হয়েই দিন কাটছে সুকুমারবাবুর। শুধু তিনি একা নন, কলকাতার সিংহভাগ প্রবীণ নাগরিকের জীবনেই গভীর প্রভাব ফেলেছে করোনা। যার ফলে তাঁরা বিরক্ত, জেদি, বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন বলে জানাচ্ছেন মনোবিদ-গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, করোনা পজ়িটিভ হলে আইসোলেশনে থাকা, অন্যদের মধ্যে সেই রোগীকে ব্রাত্য করার মনোভাব, করোনা রোগীর মৃত্যু হলে সৎকারের যা প্রক্রিয়া সে সব সম্পর্কে প্রতিনিয়ত খবর পড়া/দেখা তাঁদের মধ্যে শুধু আতঙ্ক নয়, জীবন সম্পর্কে এক ধরনের 'উইথড্রয়াল'ও তৈরি করছে।
এমনিতেই কলকাতায় জনসংখ্যার অনুপাতে বয়স্ক মানুষের হার অন্য শহরের তুলনায় বেশি। চেন্নাই, মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরুতে ষাটোর্ধ্ব মানুষের হার যেখানে যথাক্রমে ৯.৯, ৮.৯, ৭.৮ এবং ৭.৭ শতাংশ, সেখানে কলকাতায় ১১.৭৬ শতাংশ। ২০১১ সালের জনগণনা এ-ও বলছে, নিঃসঙ্গ বয়স্কের সংখ্যা দেশের মধ্যে কলকাতাতেই সর্বাধিক! তাঁরা মূলত পরিচারিকা বা আয়ার উপরে নির্ভর করেন। কিন্তু কোভিড-১৯ সেই নির্ভরতার ভিতেই আঘাত করেছে।
যেমন যোধপুর পার্কের বাসিন্দা বাষট্টি বছরের কমল সরকার বলছিলেন, ‘‘লকডাউন পর্বের
শুরুতে রাস্তায় বেরোইনি। যিনি কাজ করেন, তিনিও আসছিলেন না। পাশের বাড়ির লোকই ওষুধ, সপ্তাহের বাজার এনে দিতেন। এখন সবাই বারণ করলেও জোর করে বাজারে যাই। না হলে দমবন্ধ লাগে।’’
‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন সায়েন্সেস’-এর ‘ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়’ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষেরই কিছু না কিছু ক্রনিক অসুখ রয়েছে। এ জন্য নিয়মিত চেক-আপ দরকার। কোভিড পরিস্থিতিতে তা ব্যাহত হয়েছে। অপরাজিতার কথায়, ‘‘এমনিই বয়স বাড়লে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বাড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বয়স্কদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১০ শতাংশ বয়স্ক মানুষ এখন অবসাদে ভুগছেন!’’
ঘরবন্দি অবস্থায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিরক্তি, রাগ। উল্টোডাঙার দেবাঞ্জন সাহা বলছিলেন, ‘‘মায়ের বয়স আটষট্টি। এমনিতে মা হাসিখুশি। কিন্তু এখন কিছু বললেই ভুল বুঝছেন, কথায় কথায় রেগে যাচ্ছেন।’’ মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, বয়স্কদের নিজস্ব রুটিন হল একটু বেরোনো, সমবয়সিদের সঙ্গে গল্পগুজব। সে সবে ছেদ পড়া বিরক্তির অন্যতম কারণ।
আরও একটি কারণ, বাড়ির ছোটরা অনেক বেশি কর্তৃত্ব দেখাচ্ছেন তাঁদের উপরে। ‘এটা করবে না’, ‘হাত ধুয়ে নাও এখনই’, ‘বাইরে যেও না’ বলে বার বার বয়স্কদের সতর্ক করছেন। মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক প্রশান্তকুমার রায়ের কথায়, ‘‘বার বার বারণ করায় বয়স্ক মানুষদের জেদও বেড়ে যাচ্ছে। মাস্ক পরব না, কী হবে, এই মানসিকতাও অনেকের মধ্যেই খেয়াল করছি।’’ ‘ইন্ডিয়ান সোশিয়োলজিক্যাল সোসাইটি’-র আহ্বায়ক মহেশ শুক্ল আবার বলছেন, ‘‘বয়স্কদের সঙ্গে কথোপকথনে অন্যদের অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত এখন।’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষক আবার তথ্য দিয়ে জানাচ্ছেন, রাজ্যের ৭.৫ শতাংশ বয়স্ক কোনও না কোনও ভাবে শারীরিক, মানসিক বা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অসম্মান ও অবহেলার শিকার। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সেই নিগ্রহের মাত্রা বাড়িয়েছে বলেই আশঙ্কা। যেমন ভাবে বেড়েছে গার্হস্থ্য হিংসা। ওই গবেষকের কথায়, ‘‘বেশির ভাগ সময়েই বয়স্ক মানুষেরা মূলস্রোত থেকে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। এই ব্রাত্য হওয়ার সূত্রপাত কিন্তু পরিবার থেকেই। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত বোঝাচ্ছে যে, ব্রাত্য করে নয়, বরং বয়স্কদের সঙ্গে সহাবস্থান শিখতে হবে শহরকে।’’ (চলবে)