হাঁটুতে ব্যথা। চলাফেরায় অসুবিধা হচ্ছে। টাকার তেমন অভাব নেই। তাই অস্ত্রোপচার করে হাঁটুটা বদলে ফেললেই সমস্যা থেকে মুক্তি। এমন একটা ধারণা ইদানীং দেখা দিচ্ছে অনেকের মধ্যে।
হাঁটু প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হার যত বাড়ছে, রোগী-ডাক্তার উভয়েরই অস্ত্রোপচারের দিকে ঝোঁকার প্রবণতাও তত বাড়ছে। কিন্তু হাঁটু ব্যথা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় কি হাঁটু প্রতিস্থাপন? বিকল্প কোনও পথই কি নেই? ইদানীং এই প্রশ্ন নানা ভাবেই সামনে আসছে। বিকল্পের পথে না-হেঁটে বাণিজ্যিক কারণে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ গোড়াতেই অস্ত্রোপচারের দিকে ঝুঁকছেন কি না, তৈরি হয়েছে সেই বিতর্কও।
চিকিৎসকদের একটা অংশের মতে, হাঁটু প্রতিস্থাপন নিয়ে ইদানীং এক ধরনের তাড়াহুড়ো শুরু হয়েছে, যা বিপজ্জনক। যখন আর কোনও পথ থাকে না, শুধুমাত্র তখনই অস্ত্রোপচারের কথা ভাবা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা। আবার অন্য অংশের বক্তব্য, হাঁটু ব্যথা শুরু হলে জীবনযাত্রার মান দ্রুত যে ভাবে নামতে শুরু করে, তাতে সময় থাকতে অস্ত্রোপচার করিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। তা না হলে ভাল ফল পাওয়া যায় না।
পূর্ব ভারতে নয়ের দশকের গোড়া থেকে হাঁটু প্রতিস্থাপন করছেন অর্থোপেডিক প্রবীরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাফ কথা, ‘‘অস্ত্রোপচার হল খোদার ওপর খোদকারি। যখন ব্যথা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে, পা বেঁকে যায়, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচাটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখনই আমি অস্ত্রোপচারের কথা বলি। তার আগে নয়।’’
ফিজিক্যাল মেডিসিন-এর চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক বিষয়টিকে ভাবতে চেয়েছেন অন্য ভাবে। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু হাঁটু প্রতিস্থাপনের কথা না বলে ডাক্তাররা যদি নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভাস, ওজন না-বাড়ানোর মতো বিষয়গুলির দিকে আর একটু নজর দিতেন, তা হলে ভাল হতো।’’ তাঁর মতে, এমন বহু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে প্রতিস্থাপনই একমাত্র বিকল্প নয়। জীবনযাত্রা খানিকটা বদলালে উপকার পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা সে কথা রোগীকে জানাতে উৎসাহী হন না। সমস্যা হলে হাঁটু বদলে নেব— এই মানসিকতার পরিবর্তে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনটাই যাতে না পড়ে, সে জন্য গোড়া
থেকেই রোগীদের যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ডাক্তাররা বলছেন, হাঁটুর ক্ষয় হয় নানা কারণে। জিনগত কারণ, হাঁটুর গঠনগত ত্রুটি, কোনও ধরনের চোট বা সংক্রমণ, এ ছাড়াও আরও কত কী। এ ছাড়া রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস কিংবা অপুষ্টির কারণে হাঁটুর সমস্যা তো রয়েইছে। এই ধরনের সমস্যার প্রতিটির ক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপন জরুরি নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন জরুরি। কিন্তু চিকিৎসকরা তো বটেই, ইদানিং রোগীরা নিজেরাই হাঁটু প্রতিস্থাপন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অর্থোপেডিক রামেন্দু হোমচৌধুরীর কথায়, ‘‘হাঁটুতে ব্যথা। অফিস থেকে চিকিৎসার খরচ পাওয়া যাবে। কিছু দিন পরেই অবসর নেবেন। তার আগে অস্ত্রোপচারটা করিয়ে নেওয়া যাক— এমন মানসিকতা থাকা একেবারেই উচিত নয়। হাঁটুর স্বাভাবিকতা যখন চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত, দৈনন্দিন কাজ বা চলাফেরাও করা যাচ্ছে না, একমাত্র তখনই এ নিয়ে ভাবা উচিত।’’
কখন অস্ত্রোপচার জরুরি, আর কখন নয়— তা নিয়ে আমেরিকান ‘অ্যাকাডেমি অফ অর্থোপেডিক সার্জনস’-এর নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। কিন্তু এ দেশে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও রূপরেখা তৈরি হয়নি। রিউম্যাটোলজিস্ট অলোকেন্দু ঘোষের বক্তব্য, খুব দেরি হয়ে গেলে যেমন সমস্যা, তেমন খুব তাড়াতাড়ি অস্ত্রোপচারটাও কাজের নয়। তিনি বলেন, ‘‘ব্যায়াম, ওষুধ, ইঞ্জেকশন সবই যদি হার মানে, সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করিয়ে নেওয়াটাই শ্রেয়। আমার কাছে হাঁটুর সমস্যা নিয়ে ১০০ জন এলে তাঁদের মধ্যে হয়তো ২০-২৫ জনকে প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিই।’’
কেন খুব তাড়াতাড়ি হাঁটু প্রতিস্থাপন উচিত নয়? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ৮৫% ক্ষেত্রে হাঁটু প্রতিস্থাপন করলে তা ২০ বছর টিঁকে যায়। আর ১০ থেকে ১৫% ক্ষেত্রে ১০ বছরের মধ্যে ফের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে। যত কম বয়সে অস্ত্রোপচার হবে, দ্বিতীয় বার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন তত বাড়বে। তা ছাড়া হাঁটু প্রতিস্থাপনে বেশ কিছু ঝুঁকির দিকও রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হল সংক্রমণ। এ ছাড়া নকল হাঁটু যদি ঠিক ভাবে বসানো না হলে তা আলগা হয়ে বিপত্তি বাধে। আবার অস্ত্রোপচার ভাল হওয়া সত্ত্বেও ফাইব্রোসিস হয়ে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, হুটহাট অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এগুলি বিবেচনায় রাখাটা খুবই জরুরি।