‘বিগ ব্রাদার’ খ্যাত জেড গুডিকে মনে আছে নিশ্চয়ই? এই রিয়্যালিটি শোয়ের তারকা বিগ ব্রাদারের ঘরে শিল্পা শেট্টির সঙ্গে বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ করেছিলেন। প্রবল বিতর্কের মাঝেই তিনি ২০০৮-এ ভারতের ‘বিগ বস’ শো’টিতে যোগ দেন। কিন্তু সারভাইক্যাল ক্যানসার ধরা পড়ায় শো ছেড়ে দেশে ফিরে যান। পরের বছরই প্রয়াত হন মাত্র ২৭ বছরের জেড। তাঁর রোগযন্ত্রণার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা টিভিতে দেখার পর অনেকেই সারভাইক্যাল ক্যানসার অসুখটি নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়েই চিকিৎসকেরা জোর দিয়ে বলেছিলেন, ঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে ও কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে রোগটিকে আটকে দেওয়া সম্ভব।
২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু জানিয়েছিল, প্রায় ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে এই ক্যানসার হয়। এই ভাইরাসকে আটকানোর টিকা নিলে এবং প্রতিরোধবিধি সম্পর্কে সচেতন থাকলে এই রোগটিকে নির্মূল করা যাবে বলেছে তারা। চিকিৎসকেরা বলেন, আমাদের দেশে সারভাইক্যাল ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা ভীষণ জরুরি। তার কারণ, বিশ্ব জুড়ে এই অসুখের ফলে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের ২৫ শতাংশই এই দেশের মানুষ। কী ভাবে এই ক্যানসারকে প্রতিহত করা যাবে, বিশদে আলোচনা করলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত।
কেন হয় এই অসুখ?
জরায়ুর নীচের অংশকে সারভিক্স বলে। কিছু আভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মাধ্যমে এই অংশটা চিকিৎসক দেখতে পান। এই অংশে ক্যানসার হলে তাকে সারভাইক্যাল ক্যানসার বলে। ডা. দাশগুপ্ত বললেন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসটি (এইচপিভি) যৌন সম্পর্কের ফলে ছড়ায়। এই ভাইরাসের কয়েকটি সাব টাইপ মেয়েদের জরায়ুমুখের এই ক্যানসারটির বড় কারণ। অল্প বয়স থেকে যৌন জীবন শুরু, একাধিক যৌন সঙ্গী, ধূমপায়ী ও ঋতুস্বাস্থ্য বিষয়ে উদাসীন হলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। ক্রনিক অসুখ, এইচআইভি রোগ, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও এই অসুখের রিস্ক ফ্যাক্টর। অনেকেরই শরীরে এই ভাইরাস থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তা আপনাআপনি চলে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে তা শরীরে থেকে যায় ও কোষের পরিবর্তন ঘটায়। সাধারণত ত্রিশোর্ধ্ব মহিলাদের এই রোগ হয়।
লক্ষণ চিনুন
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটি ধরে গেলে ঋতুচক্রের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। অস্বাভাবিক বা কটু গন্ধযুক্ত ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জও হতে পারে।
ব্যক্তিগত মুহূর্তের পর রক্তপাত হতে পারে।
ঋতুবন্ধের পর রক্তপাত হয়।
তলপেটে, কোমরে ব্যথা অনুভব হয়।
এ সব ক্ষেত্রে কালবিলম্ব না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। তবে অনেকেই রোগটি হয়েছে বলে বুঝতে পারেন না, কারণ কোনও লক্ষণই থাকে না। প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করতে গিয়ে ধরা পড়ে।
আগে থেকে প্রতিরোধ করুন
ডা. দাশগুপ্ত জানালেন, এই রোগের টিকা আছে। তবে রোগ ধরে গেলে টিকা তত ভাল কাজ করবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিশেষত যৌন জীবন শুরুর আগে টিকা দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। দশ-এগারো বছর হলেই মেয়েদের এই প্রতিষেধক দেওয়া যায়। পনেরো বছরের নীচে দুটো ডোজ় ও তার উপরে তিনটে ডোজ় লাগে। এই ভ্যাকসিন রোগের আশঙ্কা অনেকটাই (৮৫ শতাংশ) কমিয়ে দেয়।
বেশির ভাগ ক্যানসারই আগে থেকে ধরা যায় না। কিন্তু এই ধরনের ক্যানসার শরীরে বাসা বাঁধার আগে থেকেই বোঝা যায়। পশ্চিমের দেশগুলোতে আগের শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকেই এই রোগের স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম আছে। এই প্রকল্পের আওতায় ২৫-৬৫ বছর বয়সি মহিলাদের প্রত্যেক তিন বছর অন্তর পরীক্ষা করে দেখা হয় যে, তাঁদের এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বহু দেশ থেকেই রোগটি উৎখাত হয়ে গিয়েছে বলা চলে।
ক্যানসার হওয়ার আগে কোষগুলিতে কিছু পরিবর্তন হয়। একে প্রি-ক্যানসারাস স্টেজ বলা হয়। এই পর্বে সারভাইক্যাল প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করে রোগটিকে ধরা গেলে চিকিৎসা করে পুরোপুরি সারিয়ে দেওয়া যায়। এই পরীক্ষার জন্য ভর্তি হওয়ারও দরকার নেই। আউটডোর ক্লিনিকেই হয়ে যায়। একটি ব্রাশ দিয়ে জরায়ুর মুখ থেকে কিছুটা রস সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় দেখার জন্য যে, পরিবর্তন হচ্ছে অর্থাৎ প্রি ক্যানসারাস স্টেজে রয়েছে এমন কোষ পাওয়া যাচ্ছে কি না। সে রকম কিছু পাওয়া গেলে, কতটা ‘অ্যাবনর্মালিটি’ রয়েছে, তার উপর নির্ভর করবে চিকিৎসাপদ্ধতি। বড় অপারেশন করতে হতে পারে অথবা চিকিৎসাতেও রোগ সেরে যেতে পারে। ২৫-৬৫ বছর পর্যন্ত মহিলাদের তিন বছর অন্তর প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করিয়ে যাওয়া দরকার— বললেন ডা. দাশগুপ্ত।
এইচপিভি টেস্টিংও হয়। এতে ক্যানসার নির্ণীত হয় না, তবে কার এই রোগের ঝুঁকি আছে, তা জানা যায়।
রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিলেন ডা. দাশগুপ্ত। ধূমপান থেকে বিরত থাকা, ব্যক্তিগত অঙ্গের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার খেয়াল রাখা, ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে কন্ডোম ব্যবহার করা প্রয়োজন।
চিকিৎসার ধরন
রোগ ধরে গেলে তা কতটা জটিল বা কতটা ছড়িয়েছে তা দেখে রোগের স্টেজ নির্ধারণ করেন চিকিৎসক। সারভিক্সের বাইরে, তলপেটের অন্যত্র, ইউটেরাস-ওভারিতে ছড়িয়েছে কি না, রোগ কতটা অ্যাডভান্সড পর্যায়ে রয়েছে তা দেখা হয়। কোন স্টেজে রোগ আছে, তার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা চলে।
খুব আর্লি স্টেজে, খুব ছোট ক্যানসার থাকলে, সারভিক্সের ভিতরেও যদি না ছড়িয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে ক্যানসারের জায়গা বা তার আশপাশের জায়গা সার্জারি করে বাদ দেওয়া যায়। তাতেই নিরাময় হবে। আর একটু ছড়ালে ইউটেরাস, ওভারি ইত্যাদি বাদ দিতে হতে পারে। এ ভাবে অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
অনেকটা ছড়িয়ে গেলে বড় অপারেশন করতে হয়। অপারেশন করার পর্যায় ছাড়িয়ে গেলে কেমোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপির সাহায্য নিতে হয়। রোগটি অ্যাডভান্সড স্টেজে অনেক দিন রেখে দিলে সারভিক্স থেকে জরায়ু, ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব, ব্লাডার ও তলপেটের অন্য অঙ্গ, এমনকি পেটের উপরের অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। রোগ ছড়াচ্ছে কি না সে দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। তাই নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হবে। স্টেজিং বাড়লে জীবনের মান কমে, আয়ুও কমতে পারে।
ডা. দাশগুপ্ত বলছেন প্রাইমারি প্রিভেনশন হল ভ্যাকসিন আর সেকেন্ডারি প্রিভেনশন হল প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট। দুটোই এ দেশে সহজেই মেলে। জন স্বাস্থ্য প্রকল্পে এই প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের ব্যবস্থা থাকলে এবং সব মহিলাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করলে এই রোগ এ দেশ থেকেও নির্মূল হবে।