সৌরভের যেটা হয়েছে, চিকিৎসার পরিভাষায় তাকে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন’ বলে। —ফাইল চিত্র।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, হার্ট অ্যাটাক কিন্তু জানান দিয়েই আসে। উপসর্গ থাকে। তা সে যতই মৃদু হোক না কেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও হয়তো উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। উনি হয়তো বুঝতে পারেননি। সৌরভ তো স্পোর্টস পার্সন। রুটিন মেনে এক্সারসাইজের অভ্যাস আছে। এমনও হতে পারে, উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও তিনি শারীরিক কসরত করতেন। এতে কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আবারও বলছি, হার্ট অ্যাটাক না জানান দিয়ে আসে না।
এমনিতে বয়স ৪৫ পেরোলে কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, এই বয়সে অনেক রকমের রিস্ক ফ্যাক্টর তৈরি হয়। তবে সকলের ক্ষেত্রেই হয়, এমনটা নয়। সৌরভের ক্ষেত্রে এই ফ্যাক্টরগুলো অনেকটাই কম বলে আমার ধারণা। প্রথমত, ডায়বেটিক নন। দ্বিতীয়ত, ধূমপান করেন না। তবে এ ক্ষেত্রে পারিবারিক রিস্ক ফ্যাক্টর হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে থাকতে পারে। আমি জানি, সৌরভের বাবা চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়ের হার্টের সমস্যা ছিল। হার্টে রক্ত চলাচলের সমস্যা ছিল তাঁর। ফলে, সৌরভের অনেকটাই সাবধানে থাকা উচিত। উচিত নয়, সাবধানে থাকাটা ওঁর ক্ষেত্রে জরুরি।
সৌরভের যেটা হয়েছে, চিকিৎসার পরিভাষায় তাকে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন’ বলে। আঙুলে চেপে সুতো বেঁধে দিলে যেমন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ব্যথা হয়, আঙুলের অনুভূতি চলে যায়, এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমন। হার্টের কোনও এলাকায় যখন রক্ত পৌঁছয় না, তখন ব্যথা শুরু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় হার্টের পেশি। তখনই হার্ট অ্যাটাকের মতো সমস্যা দেখা যায়। হাসপাতালের বিবৃতি বলছে, জিম করার সময় সৌরভ আচমকাই অসুস্থতা বোধ করেন। ব্ল্যাক আউটও হয়ে যান। এই ব্ল্যাক আউট ব্যাপারটা তখনই হয় যখন আমাদের হার্ট রেট অত্যন্ত কমে যায়। সাধারণ ভাবে এক জন সুস্থ মানুষের হার্ট রেট ৭৫ বা ৮০। সেটা যদি আচমকাই ৩০-এ নেমে যায়, তখন হৃৎপিণ্ড এতটাই স্তিমিত হয়ে যাবে যে মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছবে না। তখনই এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা ব্ল্যাক আউট হতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু চেন সিস্টেমে হতে থাকে। আর এই সিস্টেমের প্রথম ধাপ ধমনীতে ব্লকেজ। তার পর রক্ত সরবরাহ বন্ধ হওয়া। তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি। পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে হৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ছন্দ হারায়। গতি কমতে থাকে। এই গতি বা হার্ট রেট অত্যন্ত কমে গেলেই কিন্তু ব্ল্যাক আউট।
আরও পড়ুন: ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এ নিজে হাসপাতালে আসায় আপাতত স্থিতিশীল সৌরভ
আরও পড়ুন: সৌরভকে দেখতে মমতা ও ধনখড়, দিদিকে দাদার প্রশ্ন, ‘কেমন আছেন’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ধমনীতে ব্লকেজ কী ভাবে হয়? সাধারণত কোলেস্টরল জমেই রক্ত জমাট বাঁধে। সরু হয়ে আসা ধমনীতে রক্ত চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায় ধীরে ধীরে। তাই ব্লকেজ এড়াতে কোলেস্টরল বাড়ে এমন কিছু এড়িয়ে চলাই ভাল। তবে মুশকিল হল এমন অনেক কিছুই আছে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলেও শরীরে কোলেস্টরল পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে মানসিক চাপ, অবসাদ, অত্যন্ত বেশি পরিমাণে শারীরিক কসরত বা পরিশ্রম—এই বিষয়গুলো অনেক সময়েই দেখা যায় যে, ছোটখাটো ব্লকেজকেও মারাত্মক আকার দিয়ে দিচ্ছে। পৌঁছে দিচ্ছে ক্ষতিকর জায়গায়। তাই খেয়াল রাখা জরুরি।
সৌরভের মেডিক্যাল রিপোর্টে হাইপোকাইনেসিয়ার কথা বলা হয়েছে। এই হাইপোকাইনেসিয়া মানে হল হার্টের একটি অংশ ভাল কাজ করছে না। কারণ হার্টের পেশি খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হার্টের পেশিই কিন্তু তাকে পাম্প করতে সাহায্য করে। এ জন্য এই পেশির প্রচুর অক্সিজেন আর রক্ত প্রয়োজন হয়। ধমণী যদি সেই রক্ত সরবরাহ না করতে পারে, যদি পেশি আধপেটা খেয়ে থাকে তা হলেই তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রভাব ফেলবে হার্ট রেটে। ধরা যাক হার্টের ১০০টি পেশির মধ্যে ২০টি ক্ষতিগ্রস্ত হল, এই বিষয়টিকেই সহজ ভাষায় বলব হার্ট অ্যাটাক।
যা জানতে পেরেছি, সৌরভের তিনটি ধমনীতে ব্লকেজ রয়েছে। ফলে ওঁর চিকিৎসা কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছে। এখন যদি সারা পৃথিবীর গবেষণা মানা হয়, তবে দেখা যাবে দীর্ঘমেয়াদে তিনটি ধমণীর ব্লকেজ সারাতে বাইপাস সফল। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তিনটি ধমণীতে ব্লকেজ থাকলেও তার প্রতিটিই তেমন জটিল নয়। এই ধরনের কম জটিল ব্লকেজগুলোকে নন কমপ্লেক্স ব্লক বলে। সৌরভের যদি নন কমপ্লেক্স ব্লক থেকে থাকে তবে সেখানে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার কথা ভাবা যেতে পারে।