নাকের উপরে টপ-টপ করে জল পড়ছে। জাদুকর ইথান মাসকারেনহাস সর্বশক্তি দিয়ে মাথাটা সরাতে চাইছেন, পারছেন না।
হৃতিক রোশন অভিনীত ‘গুজারিশ’ ছবির ওই দৃশ্যটা মনে পড়তে পারে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি-র (বিআইএন) দোতলায় আইটিইউ আটে এসে দাঁড়ালে। একটা মাছি ঘুরে ফিরে বসছে বেডে শোওয়া ছেলেটার ঠোঁটে-নাকে। সে মাথা ঘুরিয়ে সরাতে চাইছে। মাছিটা আবার এসে বসছে। শেষ পর্যন্ত এক জন ওটি সিস্টার এসে মাছিটা হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার পর একটু স্বস্তি পেল সে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়েই বলল, ‘‘এই ভাবে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ আছে? আপনিই বলুন?’’
টানা ছ’বছর ভেন্টিলেশনে রয়েছে সোনু যাদব। দৌড়তে গিয়ে রাস্তায় পড়ে গুরুতর চোট পেয়েছিল। সেটা ২০০৯ সালের অগস্ট মাসের কথা। হাসপাতালের শয্যায় ভেন্টিলেশনে শ্বাস নিতে নিতেই সে দিনের এগারো বছরের বালক আজ যৌবনের দোড়গোড়ায়। বিআইএনের আটটি ভেন্টিলেটরের মধ্যে একটি গত ছ’বছর ধরে শুধু সোনুর জন্যই বরাদ্দ। পশ্চিমবঙ্গে এত বেশি দিন কারও ভেন্টিলেটারে থাকার উদাহরণ চিকিৎসকেরা চট করে মনে করতে পারছেন না। বেশি দিন ভেন্টিলেটরে থাকলে নানা রকম সংক্রমণ ছড়াতে দেখা যায়। সোনুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। যত্নে থাকায় বেডসোরও হয়নি। অথচ ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌগত দাশগুপ্ত, পবন অগ্রবালদের অভিজ্ঞতা বলছে, ‘‘সাধারণত কয়েক মাস ভেন্টিলেটরে থাকলেই অনেক শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। বেশির ভাগ মানুষই তাই ফিরে আসেন না। সেখানে এই ছেলেটি ছ’বছর ভেন্টিলেটারে রয়েছে। এ প্রায় অলৌকিক ঘটনা!’’ এই ‘অলৌকিক’ টিঁকে থাকাই যেন আরও বিচলিত করছে চিকিৎসকদের। তাঁরা সখেদে বলছেন, ‘‘একটা মানুষকে প্রকৃতি জীবনের কিনারে নিয়ে গিয়েও ঠেকিয়ে রেখেছে, অথচ আমরা তাকে ‘কোয়ালিটি লাইফ’ দিয়ে সাহায্য করতে পারছি না!’’
সোনুর গলার নীচ থেকে গোটা শরীরটাই অসাড়। নিজে থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও নেই। এই অসুখকে বলে ‘কোয়াড্রিপ্লেজিক উইথ রেসপিরেটরি ইনভলভমেন্ট’। জন্ম থেকেই সোনুর ‘ক্রেনিও ভার্টিব্রাল জাংশন অ্যানোমালি’ ছিল। তার উপরে আঘাত লেগে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ভেন্টিলেশনের নল শরীর থেকে খুলে নিলেই মৃত্যু হবে সোনু-র। কিন্তু মুখ আর মস্তিষ্ক পুরোপুরি সুস্থ। ফলে শরীরটি স্থবির হলেও মস্তিষ্কের জোরেই সোনু যথেষ্ট সপ্রতিভ, চিন্তাশীল। গুছিয়ে কথা বলে। গান গায়, গান শোনে। গল্প করে। চিবিয়ে খাবার খেতে পারে। সোনুর মা বাসন্তীদেবী প্রতিদিন বাড়ি থেকে খাবার এনে ছেলেকে খাইয়ে দেন।
নিম্নবিত্ত পরিবার। সোনুর বাবা অনিলকুমার যাদব হাওড়ার ব্যাঁটরায় একটি চায়ের দোকান চালান। বেসরকারি হাসপাতাল হলে সোনুর চিকিৎসা চালাতে পারতেন না তাঁরা। সরকারি হাসপাতাল বলেই বেঁচে রয়েছে সোনু। ছ’বছর ধরে সোনুর জন্য সরকার প্রতিদিন প্রায় ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা চালাচ্ছে। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন? কী এর পরিণতি? বিআইএন-এর চিকিৎসকরাও জানেন না তা।
সোনুরও এক বছর আগে থেকে ভেন্টিলেশনে রয়েছেন কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। দীর্ঘ চিকিৎসার পরেও সাড়া দিচ্ছে না তাঁর মস্তিষ্ক। প্রিয়বাবুর মতো ‘ভেজিটেটিভ কন্ডিশন’ সোনুর নয়। মুম্বইয়ের হাসপাতালে অরুণা শনবাগ যে ভাবে ৪২ বছর ‘কোমা’-য় ছিলেন, সেই রকম অবস্থাও নয় তার। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে অন্ধ্রের ভেঙ্কটেশ নিজেই যে ভাবে নিষ্কৃতি মৃত্যু চেয়েছিল, সোনুর জীবন তেমনটাও নয়। একশো শতাংশ হুঁশে থাকা এক যুবক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা জীবন, যেখানে চোখের উপর উড়ে আসা চুল সরিয়ে দেওয়ার জন্যও তাকে পরের উপর নির্ভর করতে হয় এবং হবে। কত দিন, কেউ জানে না। সোনু সব কিছু বোঝে-জানে, এইটাই চিকিৎসকদের মতে, তার যন্ত্রণাটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবু ছেলেকে হারানোর কথা ভাবলেই শিউরে ওঠেন তার মা-বাবা। সোনু এবং তার পরিবার বরং স্বপ্ন দেখে এমন একটা জীবনের, যেখানে সোনুর ন্যূনতম স্বনির্ভরতা থাকবে। সদ্য পরিচিত সাংবাদিকের চোখের দিকে তাকিয়ে সোনু বলে, ‘‘এই রকম অবস্থায় আর কিছু ভাবতে পারি না। সুস্থ থাকলে বাবার জন্য, মা-র জন্য কিছু করতাম। এখন শুধু মনে হয়, বাড়িতে থাকতে পারলে আর লোকের বোঝা না হলে ভাল হতো।’’
কোনও ভাবে কি তা সম্ভব? ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে পড়ে যাচ্ছিল হলিউডের ‘সুপারম্যান’ খ্যাত তারকা ক্রিস্টোফার রিভ-এর কথা। ১৯৯৫ সালে ঘোড়া থেকে পড়ে শিরদাঁড়ায় মারাত্মক চোট পেয়ে ঠিক সোনু-র মতোই অবস্থা হয়েছিল ক্রিস্টোফার-এর। হুইলচেয়ার বন্দি হয়ে, সর্বক্ষণ পোর্টেবল ভেন্টিলেটর সঙ্গী করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন। সেই অবস্থাতেই মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্তদের পুনর্বাসন নিয়ে প্রচারের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। স্টিফেন হকিংয়ের উদাহরণও তো রয়েছে। তাঁরও মস্তিষ্ক সতেজ, দেহ অসাড়। তবু তাঁর কাজ থামেনি।
রিহ্যাব ফিজিশিয়ান রাজেশ প্রামাণিকের কথায়, জিভ দিয়ে চালানো যায় এমন অত্যাধুনিক হুইলচেয়ার রয়েছে বিদেশে। কোটি টাকা দাম। এতে ভেন্টিলেটর থাকে। তা ছাড়া ‘জয় স্টিক’ বলে একটা যন্ত্র থাকে যার মাধ্যমে সোনু-র মতো রোগীরা বই পড়া, কম্পিউটার চালানো সব করতে পারেন। কোন রোগীর কী রকম পরিষেবা লাগবে, তা দেখে ওগুলি বানানো হয়। ভারতে এতটা না হলেও বেশ কিছু আধুনিক হুইলচেয়ার রয়েছে। কিন্তু সে সব জোগাড় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি সোনুর নেই। সীমিত সঙ্গতিতে কি কিছুই করা যায় না? রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ মৌলিমাধব ঘটক এবং চিকিৎসক সন্তোষ শ্রীবাস্তবের মতে, প্রথমে এই ধরনের রোগীদের দুই হাত ও বুকের মাংসপেশীর জোর ফেরাতে বিশেষ ফিজিওথেরাপি করানো উচিত। কিছুটা জোর ফিরলে হাতের সঙ্গে এমন যন্ত্র আটকে দেওয়া যায় যা দিয়ে লেখা, খাওয়া, হুইলচেয়ার চালানোর মতো কাজ করা যাবে। সোনুর চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায় জানাচ্ছিলেন, চার-পাঁচ লাখ টাকায় একটি পোর্টেবল ভেন্টিলেটর কেনা গেলে সেটি একটি আধুনিক হুইলচেয়ারে (এর দামও ৩-৪ লাখ) লাগিয়ে সোনুকে বাড়ি পাঠানো যেতে পারে। তবে নার্সিং করার লোক, উপযুক্ত একটা খাট আর লাগাতার বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা থাকতে হবে। সোনুর মা বিড়বিড় করে বলেন, ‘‘সোনুকে টানা ভেন্টিলেশনে রাখতে সরকারের কত টাকাই তো খরচ হচ্ছে! কেউ কি এগিয়ে আসতে পারেন না সোনুর জন্য?’’