চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় দু’টি শব্দবন্ধনী রয়েছে—হেয়ার ফল (চুল পড়ে যাওয়া) এবং হেয়ার শেডিং (চুল ঝরে যাওয়া)। যে কোনও বড় ধরনের অস্ত্রোপচার, জ্বর বা সংক্রমণের পরে চুল ঝরে যাওয়ার ঘটনা বেশি দেখা যায়। করোনাও ভাইরাসঘটিত একটি সংক্রমণ, যার কারণে ব্যক্তির দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হেয়ার ফলিকলের উপরে এর বিরূপ প্রভাব বিশেষ ভাবে নজরে পড়ছে। মাথার চুল থেকে গায়ের রোম—সব ক্ষেত্রেই তার ঘনত্ব কমে পাতলা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ সন্দীপন ধরের মতে, ‘‘আগে চুল ঝরে যাওয়ার কেস দিনে দু’-তিনটি পেলে, এখন সেই সংখ্যাটা প্রায় দ্বিগুণ।’’ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণাংশু তালুকদারও এই পর্যবেক্ষণে সম্মতি জানাচ্ছেন। তবে চুল ঝরে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সেই বার্তাই দিতে চাইছেন চিকিৎসকেরা।
চুল ঝরে যাওয়া সম্পর্কিত কয়েকটি তথ্য
ডা. তালুকদারের মতে, ‘‘গড়ে একশোটি চুল রোজই ঝরে যায়। কিন্তু সেই সংখ্যা যদি তিনশো-চারশো বা পাঁচশো হয়, তখনই তা নজরে আসে।’’
অপুষ্টিজনিত কারণে চুলের রং, টেক্সচার, স্বাস্থ্যের মান নিম্নমুখী হতে পারে। কোভিডের পরে তা বাড়তে পারে। আসলে কোভিডের পরে শরীরের অনাক্রম্যতা কমে যায়। সার্বিক স্বাস্থ্যে যে ক্ষতি হয়, তার কারণেই চুলের এই দুর্দশা।
টাইফয়েড, চিকেন পক্স বা কোনও বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের পরে চুল ঝরে যাওয়া, চুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে। তাই বিষয়টি শুধু কোভিডের কারণে হবে, সেটা নয়।
কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির যখন জ্বর হয় বা আইসোলেশন পিরিয়ড চলে, তখন চুল ঝরে না। চুলের পুষ্টি অবশ্য তখন থেকেই কমতে শুরু করে। কোভিড থেকে সেরে ওঠার প্রায় এক-দেড় মাস পরে চুল ঝরে যাওয়ার ঘটনা দেখা যায়।
চুলের গ্রোথ সাইকল
ডা.সন্দীপন ধর বুঝিয়ে দিলেন, চুলের গ্রোথ সাইকলটি, ‘‘অ্যানাজেন, টেলোজেন এবং ক্যাটাজেন এই তিন পর্যায়ে হেয়ার ফলিকল সাইকলটি আবর্তিত হয়। অ্যানাজেন অর্থাৎ চুল গজানোর প্রক্রিয়া, টেলোজেন অর্থাৎ এনার্জি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া এবং ক্যাটাজেন অর্থাৎ চুল ঝরে যাওয়ার প্রক্রিয়া। কোভিড বা শরীরের গুরুতর কোনও সমস্যা হওয়ার পরে অ্যানাজেন প্রক্রিয়াটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ চুল সে পরিমাণে তৈরি হচ্ছে না, যে পরিমাণে তা ঝরে যাচ্ছে। এটিকে বলা হয় টেলোজেন এফ্লুভিয়াম।’’
চিকিৎসা
সংক্রমণজনিত কারণে চুল ঝরে গেলে তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। ছ’থেকে ন’মাস শরীরের যথাযথ পরিচর্যা করলে চুল ফিরে পাওয়া যায়।
তবে সেই ধৈর্যের পরীক্ষা ব্যক্তিকে দিতে হবে।
কোভিডের কারণে অনেকেরই হজমক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির আত্তীকরণ শরীরে ঠিকমতো হচ্ছে না। তাই ভিটামিন এবং খনিজসমৃদ্ধ ডায়েটের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
ডায়েটে ভিটামিন বি থ্রি, বায়োটিন, ভিটামিন ডি, ম্যাগনেশিয়াম, জ়িঙ্ক এবং আয়রন অবশ্যই রাখতে হবে।
রোগীকে মাল্টি-ভিটামিন ট্যাবলেটের সঙ্গে বিভিন্ন হেয়ার গ্রোয়িং সলিউশনও দেওয়া হয়। পনেরো বছর বয়সের ঊর্ধ্বে মিনক্সিডিল ব্যবহার করা হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে শতকরা তিন শতাংশ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা পাঁচ শতাংশ হেয়ার গ্রোয়িং সলিউশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খাওয়ার ওষুধ এবং হেয়ার ফলিকলে লাগানোর জন্য দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায় অ্যামিনেক্সিল।
প্রোটিনজাতীয় খাবার খাওয়ার ব্যাপারেও রোগীকে বিশেষ সচেতন থাকতে হবে।
কন্ডিশনার বা তেল এই সময়ে বেশি ব্যবহার না করলেই ভাল।
বড় দাঁতওয়ালা চিরুনি ব্যবহার করলে হেয়ার ফলিকলগুলিকে কম উত্তেজিত করা হয়।
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন।
চুল ভাল রাখা এবং তার ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য শরীরের যত্ন নেওয়া ভীষণ ভাবে জরুরি। কোভিডের পরে সেই প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে বইকি। চুল নিয়ে অনেকেই সংবেদনশীল থাকেন। তাই এ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিংয়েরও গুরুত্ব রয়েছে।