প্রায় তিন দশক আগের কথা। টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে তখন এক প্রখ্যাত মাজন সংস্থার বিজ্ঞাপন চলছে। সে সব দেখে অশীতিপর এক কবি বিরক্ত হয়ে নাতনিকে বলেছিলেন, ‘‘মাজন তো লাগায় দাঁতে। এর জন্য এত নাচন-কোঁদন কেন?’’ উত্তর ছিল না ছোট্ট মেয়ের কাছে। আজ থাকলে তিনি দেখতেন, বদলে গিয়েছে সেই উক্তি— ‘বিকৃত করিয়া মুখ, চুলকাইতে বড় সুখে’-র থেকেও বড় সুখ এখন নিজের ছবি তোলায়। যাকে বলে ‘সেলফি’ অর্থাৎ, নিজস্বী।
নিজস্বীর উন্মাদনা এমনই যে ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ জুন তারিখটি এ জন্য উৎসর্গ করতে ডাক দেন ডিজে রিক ম্যাকনিলি। যদিও এ শহরের সিংহভাগই এ কথা জানেন না। সোশ্যাল মি়ডিয়ায় কখনও নানা মুখভঙ্গীতে বা প্রেমে মাখো মাখো ছবি দেখে নিন্দুকেরা বলেন, যত ন্যাকামো! আইটি কর্মী তথা নিজস্বী পাগল দেবার্ঘ্য মিত্র সব শুনে হেসে বললেন, ‘‘এমন একটা দিন আছে বুঝি! তবে যাই বলুন, এই ন্যাকামোর উপরে ভিত্তি করেই কিন্তু ফুলে উঠছে ‘সেলফি অ্যাকসেসরিজ ইন্ডাস্ট্রি’।’’ এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকে যাওয়ার মতো তথ্য। সেলফি স্টিক, ট্রাইপড, মনোপড, সেলফি রিং লাইট-সহ আরও অনেক কিছু নিয়ে সারা বিশ্বে ২০১৭ সালের শেষে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ১,৯৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫-এর শেষে তা দাঁড়াবে ৬,৩৭১ মিলিয়ন ডলারে। যা শুনে উৎসাহিত ব্যবসায়ী-মহল ঝুঁকছে এই ব্যবসায়।
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব নিজস্বীর আকর্ষণকে মানসিক বিকৃতির আখ্যা দিচ্ছেন না। তাঁর মতে, ‘‘বেড়াতে গেলে ছবি তুলে অ্যালবামে রাখি আমরা। এটাও তেমনই। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে আকছার নিজস্বী তুলতে দেখা যায়, এই যা। এতে কোনও বিকৃতি দেখছি না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও ক্যামেরায় থাকা সেলফ টাইমারের সাহায্যে ছবি তোলা হত।’’
কিন্তু নিজস্বীর হাতছানিতে পাহাড় থেকে পড়ে, জলে ডুবে বা রেলে কাটা পড়ে আকছার ঘটে যাচ্ছে অঘটন। এর পরেও কি নিজস্বী নিয়ে মাতামাতি উচিত? অর্থনীতির গবেষক রোশনি বিশ্বাসের যুক্তি, ‘‘দুর্ঘটনাস্থলে, শোকের মধ্যে বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজস্বী তুললে, সেটা তাঁর সমস্যা। এ ভাবে না হলে, অন্য ভাবে সেই সমস্যা প্রকাশ পেতই।’’ মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ‘‘কম সময়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার তাৎক্ষণিক তাগিদে এই পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার।’’
সমস্যা যা-ই হোক, তামাম দুনিয়া ডুব দিয়েছে নিজস্বীতে। শব্দটির এক প্রকার কপিরাইট নিয়ে রেখেছে অস্ট্রেলিয়া। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরেই প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন সে দেশের এক যুবক। ঠোঁটের সেলাই কত দিনে মিলিয়ে যাবে, তা একটি ফোরামে ছবি তুলে জানান। দুঃখপ্রকাশ করে লেখেন, এটি ‘সেলফি’। অনেকে বলেন, সেই ছিল প্রথম এই শব্দের ব্যবহার। তখনও ফ্রন্ট ক্যামেরা আসেনি। স্টিভ জোবসের হাত ধরেই আসে ফ্রন্ট ক্যামেরা। জনপ্রিয়তা বাড়ায় ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ঠাঁই হয়েছে ‘সেলফি’র।