নিয়মভঙ্গ: বাণিজ্যিক বরফ রাখা রয়েছে আখের রসের যন্ত্রে। শনিবার, গড়িয়াহাটে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া শরবতে মেশানো বরফ বেশি খেলে বাচ্চাদের মনে রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, ওই শরবতে মেশানো বরফের (যা মূলত বাণিজ্যিক বরফ) মধ্যে ভারী ধাতু, দূষক ছাড়াও থাকে বিসফেনল (এক ধরনের রাসায়নিক, যা প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়)। এই বিসফেনল থাইরয়েড গ্রন্থির স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। যার প্রভাব পড়ে স্মৃতি, বাচ্চাদের ‘মেমরি ডেভেলপমেন্ট’-এ। তাই শরবতে মেশানো বাণিজ্যিক বরফ নিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
জ্বালা ধরানো গরমের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে শহরের রাস্তায় বেড়েছে পানীয়, শরবত বিক্রি। আর যাবতীয় বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে সেই শরবত, পানীয়তেই অবাধে মেশানো হচ্ছে বাণিজ্যিক বরফ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক প্রশান্তকুমার বিশ্বাস বলছেন, ‘‘বাণিজ্যিক বরফে ধাতব পদার্থের পাশাপাশি বিসফেনল মিশে থাকে। ফলে এই বরফ মেশানো পানীয়, শরবত বা জল খেলে তা মনে রাখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই প্রভাব রাতারাতি বোঝা যায় না। দীর্ঘমেয়াদে তা ক্ষতির কারণ হয়।’’
সেই ক্ষতি এড়াতেই ২০১৮ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা কমিশন বাণিজ্যিক বরফ চিহ্নিত করার জন্য তাতে ‘ইন্ডিগো কারমাইন’ নামে একটি রাসায়নিক বা নীল রং ১০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) পর্যন্ত মেশানোর কথা বলেছিল। যাতে সবাই বুঝতে পারেন যে, কোনটা বাণিজ্যিক আর কোনটা খাওয়ার বরফ। প্রসঙ্গত, ‘ইন্ডিগো কারমাইন’ বা চলতি কথায় ‘ব্রিলিয়ান্ট ব্লু’ ফুড গ্রেড রং। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট মাত্রায় ওই রং খাবারে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেখানে বাণিজ্যিক বরফের চাঁই মাছ-মাংসের পাশাপাশি ওষুধ সংরক্ষণ, সিমেন্ট কারখানা, এমনকি মৃতদেহ সংরক্ষণেও ব্যবহৃত হয়।
অথচ, খাওয়ার যোগ্য বরফের কিউব (খণ্ড) ব্যবহার না করে সেই বাণিজ্যিক বরফের চাঁই-ই সস্তায় কিনে তা পানীয়, শরবতে ব্যবহার করেন এক শ্রেণির খাদ্য ও পানীয় বিক্রেতা। যদিও রাজ্যের খাদ্য নিরাপত্তা কমিশন সূত্রের খবর, বরফকলের লাইসেন্স দেওয়া হয় ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতর থেকে। ভক্ষণযোগ্য বরফের সঙ্গে বাণিজ্যিক বরফের পার্থক্য বোঝাতে নীল রং মেশানোর নির্দেশিকা সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তার পরেও রাস্তাঘাটে এখনও নীল বরফের সন্ধান মিলছে না।
যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ওই নিয়মবিধি কতটা মানা হয়েছে, কতটা হয়নি, তা খোঁজ করে দেখা হচ্ছে।’’ কলকাতা পুরসভাও এ নিয়ে দফায় দফায় অভিযান চালালেও পানীয়, শরবতে বাণিজ্যিক বরফের ব্যবহার পুরোপুরি আটকাতে পারেনি। কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ বলছেন, ‘‘অভিযানে বেরিয়ে দেখতে পাচ্ছি যে, বাণিজ্যিক বরফ কেটে কিউব আকারে মেশানো হচ্ছে পানীয়ে, শরবতে। এটা বন্ধ করার সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, অনেক সময়ে পুকুর, নালা এমনকি অন্য কোথাও থেকে নোংরা জল তুলে তা বাণিজ্যিক বরফ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। অপরিশোধিত জল থেকে তৈরি ওই বরফ খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে। এক বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, পানীয় জল বা খাওয়ার যোগ্য বরফের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধতার নির্দিষ্ট মাত্রা মান্য করতে হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক বরফের ক্ষেত্রে তার বালাই নেই। তাঁর কথায়, ‘‘এই বরফ শরীরে ঢুকলে স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে পেটের রোগ যেমন হয়, তেমনই দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে লিভার, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি তা ক্যানসারের কারণও হতে পারে।’’