সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শহরের প্রথম সারির এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আয়া, স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্টদের বৈধ স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে! স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা হাসপাতালের এই উদ্যোগে সামিল হয়ে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ।
সরকারি হাসপাতালে আয়া ও স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্ট নিষিদ্ধ হয়েছে এক যুগেরও আগে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরই স্বীকার করছে, ঘুরপথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় তাঁরা হাসপাতালে থেকে গিয়েছেন। তবে, নিয়মের কোপ থেকে বাঁচতে নিজেদের আসল পরিচয় তাঁরা সামনে আনেন না। হাসপাতালে থাকেন রোগীর বাড়ির লোকের পরিচয়ে। আড়ালে রোগীর পরিজনের থেকে তার জন্য টাকা নেন। সবাই সব কিছু জেনেও চুপ করে থাকেন। সম্প্রতি কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আয়া বা স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্টদের আর নকল পরিচয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। তাঁদের স্বীকৃতিস্বরূপ পরিচয়পত্র বিলির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
সপ্তাহ তিনেক আগে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের রোগী-কল্যাণ সমিতির বৈঠকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের ডেপুটি সুপার সুপ্রিয় চৌধুরী, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মালা সাহা এবং স্থানীয় কাউন্সিলর তরুণ সাহা। বৈঠকের পরেই আয়া ও স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্টদের সংগঠনকে ওই হাসপাতালে কর্মরত তাদের সদস্যদের নাম জমা দিতে বলেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই নাম পাঠানো হবে বিধায়কের কাছে। তার পরে বিধায়কের অফিস থেকেই বিলি করা হবে পরিচয়পত্র। পাশাপাশি ঠিক হয়েছে, ডেপুটি সুপারের কাছে আয়াদের ডিউটি রোস্টার থাকবে এবং থাকবে একটি রেজিস্ট্রার, যাতে প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর এবং কোন বিভাগে কাজ করছেন তা উল্লেখ থাকবে। আর জি করের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিষদীয় সচিব তাপস রায় সে দিনের বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও পরে তাঁকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনিও সম্মত হন বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর।
কিন্তু রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর যাঁদের অবৈধ বলছে, তাঁদের কী ভাবে কোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা বিধায়ক পরিচয়পত্র দিতে পারে?
তাপস রায়ের মত, “আয়া নিষিদ্ধ হওয়ার এত দিন পরেও তো সরকারি হাসপাতালে তাঁরা রয়ে গিয়েছেন। এক জন একসঙ্গে সাত-আট জন রোগীর দায়িত্ব নিয়ে আছেন। কাউকে ঠিকঠাক দেখাশোনা করেন না, এ দিকে জবরদস্তি টাকা নেন। পরিচয়পত্র না থাকলে এঁদের শায়েস্তা করা যাবে না।” তাঁর আরও বক্তব্য, “তাঁদের অস্তিত্বকে অস্বীকার না করে তাঁদের কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করাতে হবে, সেই পন্থা আমাদের বার করতে হবে।”
আর জি করের আয়া ও স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্টদের সংগঠনের সাধারণ সচিব পঞ্চানন দাস ইতিমধ্যেই ১৭৩ জন আয়া ও স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্টের তালিকা তৈরি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছেন। এই ১৭৩ জনের নামেই পরিচয়পত্র তৈরি হওয়ার কথা। যিনি পরিচয়পত্র দেবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই বিধায়ক, তৃণমূলের মালা সাহা বলেন, “পরিচয়পত্রে ওঁদের ছবি, নাম-ঠিকানা, কোন বিভাগে কাজ করছেন এবং ফোন নম্বর থাকবে। তাঁরা কোনও দোষ করলে সহজে চিহ্নিত করা যাবে। রোগীদের স্বার্থেই এটা করা উচিত।”
এ দিকে এই খবরে তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মামার বাড়ি নাকি! যার যেমন ইচ্ছা, নিয়ম বানিয়ে দেবে? নিষিদ্ধ হওয়া লোকেদের বৈধ করে দেবে? তা হলে আমাদের যেমন ইচ্ছা, আমরাও ব্যবস্থা নেব। তার জন্য যেন প্রস্তুত থাকেন।” স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীরও বক্তব্য, “হাসপাতালে কোন কর্মচারী থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত কোনও হাসপাতাল নেয় না। নেবে দফতর। রোগী-কল্যাণ সমিতি কখনওই দফতরের উপরে নয়। আমরা কৈফিয়ত চেয়েছি আর জি করের থেকে।”
আর জি করের ডেপুটি সুপার সুপ্রিয়বাবু এ ব্যাপারে বলেন, “সিদ্ধান্ত একটা হয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমি কিছু বললেই এখন বিতর্ক হবে। বিষয়টা স্পর্শকাতর। নেতাদের কাছে জিজ্ঞাসা করুন।” আর সব শুনে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের জবাব, “আমি আর জি করের ওই রোগীকল্যাণ সমিতির বৈঠক সম্পর্কে কিছু জানি না। যদি এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত হয়, তা হলে নিশ্চয়ই আমাকে জানানো হবে। তখন মন্তব্য করব। এখন এ ভাবে কিছু বলব না।”