বেশ ক’দিন ধরেই মলত্যাগের সময়ে কষ্ট পাচ্ছেন সৌদামিনী। গত দু’দিন ধরে রক্তও বেরোচ্ছে। লজ্জায় ও ভয়ে কাউকে সে কথা জানাতে পারছেন না। এ দিকে বুঝতেও পারছেন না তাঁর কী হয়েছে? পাইলস, ফিশার না ফিশচুলা?
পায়ুদ্বারের মুখে এই তিন ধরনের রোগই দেখা দিতে পারে। সেডেন্টারি লাইফস্টাইলের জন্য এখন এ ধরনের রোগ প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের মধ্যেই দেখা দিচ্ছে। কারও মধ্যে এ রোগের লক্ষণ প্রকট, কারও আবার কম। কিন্তু ভয়ে বা লজ্জায় তা গোপন করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। গোড়ার দিকে চিকিৎসা শুরু করলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তার আগে জেনে নিন, এই রোগগুলির লক্ষণ কী?
রোগনির্ণয়
অনেকেরই ধারণা এই তিনটি অসুখ একই ধরনের, আসলে কিন্তু তা নয়। মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘আগে শরীরের কাজ বুঝতে হবে। মলত্যাগ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি পায়ুদ্বারের গঠনের জন্য। অনেকটা ইলাস্টিকের মতো হয় এই অংশটা। ফলে প্রয়োজন মতো সেই জায়গা প্রসারিত ও সংকুচিত করা যায়। কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য বা বারবার মলত্যাগের জন্য সেই জায়গায় অসংখ্য ছোট-ছোট শিরা-উপশিরা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। অনেক সময়ে তা থেকে রক্ত বেরোয়। তখনই এ ধরনের রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। পায়ুদ্বারের চারপাশটা যখন চিরে যায়, তখন কাটা দাগের মতো রেখা তৈরি হয়। একে বলা হয় ফিশার। আর পায়ুদ্বারের মুখে আঙুরের থোকার মতো মাংসপিণ্ড ঝুলে থাকলে তাকে বলে পাইলস। পাইলস রেকটামের ভিতরেও থাকতে পারে আবার বাইরেও থাকে। পাইলস থেকে রক্তও বেরোয়। তবে এটিতে প্রথম দিকে বিশেষ ব্যথা থাকে না। ইনফেকশন হলে ব্যথা হতে পারে। আর ফিশচুলা অনেকটা নলের মতো গঠন তৈরি করে পায়ুপথে। এর একটি মুখ রেকটামের ভিতরের দিকে থাকে আর একটি মুখ থাকে বাইরে পায়ুদ্বারের ঠিক পাশে। এই পথে এক ধরনের রস বা স্টুলের জলীয় অংশ বেরোতে থাকে। ফিশচুলা একটি আলাদা চ্যানেল তৈরি করে।’’ এই তিনটি রোগ রোগের উপশমও আলাদা।
উপশম হবে কী ভাবে?
জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘প্রথমে কষ্ট কমাতে জায়গাটা সারিয়ে তোলা প্রয়োজন। তার জন্য তিন ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। একটা হিলিং জেল, যা ইনফেকশন ও ফোলা ভাব কমায়। দ্বিতীয়টা অ্যানাস্থেটিক জেল, এই জেলে ওই জায়গায় বেদনার ভাব একটু কমে। ব্যথা বোঝা যায় না। আর পেন রিলিভিং জেল। চুলকানি ভাব ও কষ্ট কমাতে এই জেল দেওয়া হয়।’’ এই রোগগুলি হলে সিট্্স বাথও নিতে পারেন। এক গামলা ঈষদুষ্ণ জলে কোনও অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল ওষুধ দিয়ে বসতে হয়। এতে সেঁক হয়ে যায়। ফলে সেই জায়গার ব্যথা-যন্ত্রণা কমতে থাকে। তার পরে ওষুধ লাগাতে হবে।
তবে ফিশচুলা হলে সার্জারি করার দরকার পড়ে। কিন্তু সার্জারি করার আগে কোলনোস্কপি করার পরামর্শ দিলেন ডা. মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘ফিশচুলার যেহেতু দুটো ওপেনিং থাকে। ভিতরের উন্মুক্ত জায়গাটা কোথায় তা দেখার জন্য কোলনোস্কপি করা দরকার। সার্জারির পূর্বে কোলনোস্কপি করে পাইলসের সংখ্যা ও তার ঠিক অবস্থান নির্ধারণ করে নেওয়াও জরুরি।’’ এ বিষয়ে সহমত ডা. তালুকদারও। আবার ফিশচুলাও একাধিক হতে পারে। ফলে ভিতরে তার ক’টা মুখ আছে, সার্জারির আগে তা দেখে নেওয়া জরুরি বলে জানালেন তিনি।
প্রয়োজন জীবনযাপনে বদল
চিকিৎসকেরা মনে করছেন, জীবনযাপনে বদল এনে রোগগুলিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তার জন্য যা-যা করতে হবে...
প্রথমেই ফাইবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, ফাইবার ঠিকমতো খেলে রোজ কোষ্ঠ পরিষ্কারও হবে সহজে।
দিনে তিন-চার লিটার জল তো খেতেই হবে। তার সঙ্গে ফলও খেতে হবে। ফলের রস না করে ফল চিবিয়ে খাওয়াই ভাল। পেয়ারা, আপেল, নাসপাতি ইত্যাদি ফল খোসা-সহ চিবিয়ে খেলে ভাল। আর গ্লুটেনফ্রি খাবারও উপকারী।
টক দইও রাখতে হবে রোজকার পাতে। টক দই কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে সহায়ক।
খাদ্যতালিকা থেকে মাংসের পরিমাণ কমাতে হবে। মাংস কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ। বেশি মাংস খাওয়া হয়ে গেলে পরিমাণ মতো জল ও ফাইবারও খেতে হবে। আনাজপাতি রোজকার খাবারে রাখতেই হবে।
রোগের লক্ষণ বাড়লে পায়ুদ্বারে প্রেশার পড়ে, এমন কাজ থেকে দিনকয়েক বিরত থাকতে হবে। বেশি ভারী জিনিস তুলবেন না বা বইবেন না। সাইকেল চালানোর সময়েও চাপ পড়তে পারে।
সারা দিন বসে বসে কাজ না করে একটু সক্রিয় থাকতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলেও কিন্তু কোষ্ঠ পরিষ্কার থাকে। তাই রোজকার কাজের মাঝে একটু হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো ও ব্যায়াম রাখতে হবে।
শিশুদের ক্ষেত্রে
অনেক সময়ে শিশুদেরও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়। তা থেকে মলদ্বার কেটে গিয়ে রক্তও বেরোতে দেখা যায়। ডা. তালুকদার বললেন, ‘‘শিশুদের ফিশার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময়ে ছোট শিশুর রেকটাম প্রোল্যাপ্সও হয়। তখন ভিতর থেকে রেকটাম বেরিয়ে আসে। এতে আতঙ্কিত হবেন না। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে অ্যানাস্থেটিক ওষুধ লাগিয়ে তাঁরা তা ঢুকিয়ে দেন। শিশুদের শরীরের গঠন যেহেতু সম্পূর্ণ হয়নি, তাই একদম ছোটদের ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যা দেখা যেতে পারে। তবে ছোট থেকেই রোজ একটা নির্দিষ্ট সময়ে মলত্যাগের অভ্যেস করানোও জরুরি। খুব দরকার পড়লে এক-আধবার ডুজ় দেওয়া হলেও তার বেশি নয়। কৃমির ওষুধ নিয়মিত খাওয়াতে হবে।’’ দু’-তিন বছর বয়স থেকে শিশুদের খাবারে ফাইবার বা রাফেজের পরিমাণ বাড়াতে হবে। রুটি দিতে পারেন। ফলের রস না করে গোটা ফল খাওয়ালে ফাইবার পাবে বেশি।
সার্জারি কখন করাবেন?
ওষুধ ও জীবনযাপন বদলেও রোগ না সারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অপারেশনের পথ বেছে নিতে হবে। তবে একবার সার্জারি করলেই যে সারা জীবনে এ অসুখ আর হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই বলেই জানালেন ডা. মণ্ডল। এ রোগ দ্বিতীয় বারও ফিরে আসতে পারে। তাই জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির পরে সেই মাংসপিণ্ড বায়োপসি করতে পাঠানো হয়। এ ধরনের রোগ থেকে ক্যানসার হওয়ার ভয় কম। তবুও বায়োপসি করে দেখা হয়, তা ম্যালিগন্যান্ট কি না।
ইদানীং পাইলস, ফিশার, ফিশচুলার মতো সমস্যা বাড়ছে। তার কারণ স্ট্রেস, সেডেন্টারি লাইফস্টাইল বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। তাই সকলের আগে নিয়মে জীবনকে বাঁধতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করাও জরুরি। তবেই এই রোগ এড়িয়ে চলতে পারবেন।