Adoption

দত্তক নেওয়ার সহজ শর্ত

নিজের সন্তান মানেই জৈব সন্তান, এই ধারণা ভাঙার সময় এসেছে। সন্তান দত্তক নেওয়ার ইচ্ছেও বাড়ছে। তবে দত্তক নিতে হবে আইন মেনে ।

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২১ ০৫:০৮
Share:

আমাদের লোককথায়, পুরাণে, ইতিহাসে দত্তক সন্তানের সাফল্যময় জীবনের নজির কম নয়। রামের দিদি শান্তা তাঁর পালক পিতার রাজ্যের খরামুক্তিতে সাহায্য করেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও ছিলেন দত্তকপুত্র। রাজেশ খন্না, নেলসন ম্যান্ডেলা, অ্যাপল কর্তা স্টিভ জোবস-এর মতো মানুষও বড় হয়েছেন পালক পিতা বা মাতার তত্ত্বাবধানে। এত জানাবোঝা সত্ত্বেও, নতুন সহস্রাব্দের এতখানি পেরিয়ে এসেও, পালিত সন্তান নিয়ে সমাজের মনোভাব ততটা ইতিবাচক নয়। এখনও কোনও দম্পতি দত্তক নিয়েছেন শুনলে অনেকেই বিকৃত কৌতূহল প্রকাশ করে। আবার কিছু ক্ষেত্রে দম্পতির জৈবিক সন্তান জন্মালে, দত্তক শিশুকে দুর্ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আট-দশ বছরের নরম মনের শিশুকে আচমকা হোমে ফেরত দিয়ে আসতে চেয়েছেন সেই মা-বাবা। বইয়ের বদলে তার উপরে চাপিয়েছেন গৃহশ্রমের বোঝা। লাইসেন্সবিহীন হোমগুলিও দত্তক দেওয়ার নামে আইন ভেঙেছে।

Advertisement

অথচ সমাজের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে দত্তক নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানলাভের বিষয়টি তো রইলই, তা ছাড়াও দত্তকের মাধ্যমে একটি শিশুকে উন্নত মানের প্রতিপালনের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। অর্থাৎ সামাজিক সাম্যের পথে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়া যায়। দেখলে ভরসা জাগে, অনেক দম্পতিই বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অর্থ ও সময় ব্যয় করার বদলে দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছেন। সন্তান দত্তক নিয়ে সুখী জীবন কাটাচ্ছেন, তারকা-বৃত্তের বাইরেও এমন উদাহরণ অনেক। তবে শিশুর সুরক্ষার খাতিরে ও অপরাধচক্র বন্ধ করার প্রয়োজনে দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা এখন আইননির্দিষ্ট। কোনও ধাপে সামান্যতম সমস্যা দেখা দিলেই আবেদন বাতিল করা হয়। ফলে নিয়মগুলি কিছু দিন অন্তরই পালটে যায়।

এখন কোনও মিশন, হোম বা হাসপাতাল থেকে বা অভাবী মা-বাবাকে টাকা দিয়ে সরাসরি দত্তক নেওয়া যায় না। আইনসম্মত পথে দত্তক নেওয়ার জন্য প্রথমেই ভারত সরকারের শিশু ও নারী কল্যাণ দফতরের অন্তর্গত ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’ (কারা)-র পোর্টালে গিয়ে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। কারা-র ওয়েব অ্যাড্রেসটি হল cara.nic.in। কে এবং কেন আবেদন করছেন এই সব তথ্য খুঁটিয়ে দেখে, তাঁর বাড়ি পরিদর্শনের পর সেই আবেদন মঞ্জুর অথবা খারিজ হয়। আবেদন মঞ্জুর হলে কিছু দিন অপেক্ষার পর আদালতের তত্ত্বাবধানে শিশু বাড়িতে আসে।

Advertisement

সন্তান দত্তক নেওয়ার যোগ্যতা

ভারতীয় নাগরিক, প্রবাসী ভারতীয় ও বিদেশিরা ভারত থেকে শিশু দত্তক নিতে পারবেন, তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রের নিয়ম হবে আলাদা। যাঁরা দত্তক নিতে চান তাঁদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থতা এবং আর্থিক সঙ্গতির প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে।

বিবাহিত দম্পতি ছাড়াও অবিবাহিত পুরুষ বা নারী দত্তক নিতে পারেন। বিবাহিত দম্পতিদের ক্ষেত্রে, বিয়ের দুই বছর পর থেকে তাঁরা দত্তক নেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত। তবে তাঁদের দু’জনেরই সম্মতি প্রয়োজন। অবিবাহিত নারী ছেলে বা মেয়ে, যে কোনও শিশুকেই দত্তক নিতে পারবেন। কিন্তু অবিবাহিত পুরুষ কোনও কন্যাকে দত্তক নিতে পারেন না।

দম্পতির অন্তত এক জনের এবং সিঙ্গল পেরেন্টের সঙ্গে শিশুর বয়সের অন্তত ২৫ বছর পার্থক্য হতে হবে। দম্পতির মোট বয়সের যোগফল ১১০ বছরের কম এবং সিঙ্গল পেরেন্টের বয়স ৫৫-র কম হতে হবে।

তিনটি বা তার বেশি সন্তান থাকলে সাধারণ অবস্থায় সন্তান দত্তক নেওয়া চলবে না। তবে এ ক্ষেত্রেও
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে, সৎ সন্তান বা যে বাচ্চাকে দীর্ঘ দিন ধরে দত্তক দেওয়া যাচ্ছে না— এমন কোনও শিশুকে দত্তক নেওয়া যেতে পারে।

কোন শিশুকে দত্তক
নেওয়া যায়...

শিশু কল্যাণ কমিটি নির্ধারণ করে কোন শিশু অনাথ, পরিত্যক্ত (কুড়িয়ে পাওয়া) বা সারেন্ডার করা হয়েছে। সাধারণত, যে শিশুর আইনি বাবা-মা বা অভিভাবক নেই, অথবা যার বাবা-মা কিংবা অভিভাবক তার দেখভাল করতে পারছেন না, সেই শিশুকে অনাথ গণ্য করে দত্তক দেওয়া হয়। যে শিশুকে রেলকামরা বা অন্য কোথাও পাওয়া গিয়েছে বা যাকে তার মা অভাব বা লোকলজ্জার কারণে জমা দিয়ে গিয়েছেন তাকেও আইনসঙ্গত ভাবে দত্তক দেওয়া হয়। সাধারণত, কয়েক মাস থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের দত্তক নেওয়া যায়।

সৎ ছেলে বা মেয়েকে, আত্মীয়ের সন্তানকেও দত্তক নেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে শিশুটির জন্মদাতা, জন্মদাত্রীর সম্মতি প্রয়োজন। শিশুর বয়স পাঁচ বছরের উপরে হলে তারও সম্মতি লাগবে।

দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়া

কারা-র ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশনের পর ইমেলের মাধ্যমে দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়া এগোবে। আবেদন মঞ্জুর হলে, কারা-র তরফে সমাজসেবী দত্তক নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি বা দম্পতির বাড়ি এসে তাঁর বিষয়ে বিশদ তথ্য ও খোঁজখবর নেবেন। পরিবার, পাড়া বা কর্মক্ষেত্রেও প্রশ্ন করতে পারেন। প্রয়োজন মনে হলে ব্যক্তি বা দম্পতির জন্য বেশ কিছু কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা হবে। দত্তক নেওয়ার সঙ্গে দায়িত্ব, মানসিক শক্তি, পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা প্রভৃতি যে বিষয়গুলি জড়িত রয়েছে, এই সেশনগুলিতে সেগুলি নিয়ে আলোচনা চলে। কাউন্সেলিংয়ের ফলাফল যায় আদালতের কাছে।

হোম সার্ভের ফলাফল সন্তোষজনক হলে, কয়েকটি অ্যাডপশন সেন্টারের তথ্য ও শিশুর প্রোফাইল আসবে ইমেল মারফত। বাচ্চাটির মেডিক্যাল রিপোর্টও আলোচনা করা হবে। দরকারে বাচ্চাটির সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হবে হবু বাবা-মাকে। যাতে দু’তরফই একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে। কেউটি পূর্ব দহরানি বিপ্লবী সঙ্ঘ (হাওড়া)-র তরফে রাকেশ ঘোষ বললেন, ‘‘দম্পতি বা ব্যক্তি পিছু সাধারণত তিনটি শিশুকে দেখানো হয়। প্রথম শিশুকে পছন্দ না হলে, কয়েক মাস পর দ্বিতীয় শিশুকে দেখানো হয়, তখনও মনস্থির না করলে কয়েক মাস পর তৃতীয় শিশুকে দেখানো হবে। তখনও যদি পছন্দ না হয় তবে তাঁদের আবার হোম স্টাডি ইত্যাদি থেকে শুরু করতে হবে।’’ সব দরকারি কাগজপত্র তৈরি করে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে জমা দিতে হবে, কোর্ট অফিসারের সামনে বসে হবু মা-বাবাকে পিটিশনে সই করতে হবে। শুনানির সময় বিচারক মা-বাবাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। তার পরে তিনি রায় দেবেন।

শিশুটি বাড়িতে আসার পরেও এজেন্সি পরিবারটির সঙ্গে দু’বছর যোগাযোগ রেখে চলবে। তাঁদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করবে, এমনকি আবারও পাড়ায় কথা বলতে পারে। বাবা-মায়ের কাছে দত্তক সন্তানটির জীবনযাত্রা কেমন, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, তার রিপোর্ট আদালতেও জমা করবে। যদি পালক বাবা-মা কোনও কারণে বাড়ি বদল করেন, তা অবশ্যই এজেন্সিকে জানাতে হবে।

দত্তক নেওয়ার পরে

কাউন্সেলিংয়ের সময়ই অভিজ্ঞ সমাজসেবীরা বুঝে নিতে পারেন, কোন বাবা-মা সন্তানকে বাড়ি আনার পর তাকে বুক দিয়ে আগলে বড় করে তুলবেন। ভবিষ্যতে সন্তানের লালনে ত্রুটির সামান্যতম সম্ভাবনাও যদি তাঁদের চোখে পড়ে, পত্রপাঠ আবেদন খারিজ করে দেন। পরিবার-বন্ধুবান্ধব বৃত্তে দত্তক নেওয়ার বিষয়টি কী ভাবে সামনে আনবেন, সেই বিষয়টি নিয়েও এই সেশনগুলিতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

অ্যাডপশন সেন্টারের সঙ্গে জড়িত মনোবিদদের কথায়, স্বাভাবিক গর্ভাবস্থাতেও কিন্তু শিশুকে বেছে নেওয়া যায় না। দত্তক নেওয়ার সময়ও সেই একই মনোভাব আনতে হবে। বরং এ ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু বেশি সংবেদনশীল। শিশুর চেহারা, তার মেধা পালক মা-বাবার সঙ্গে না মেলারই সম্ভাবনা। দত্তকের জন্য আবেদন করার আগেই এই বিষয়ে মনকে তৈরি করে নিতে হবে। পড়াশোনায় বাচ্চাটি দুর্দান্ত না-ই হতে পারে, অন্য কোনও গুণ নিশ্চয়ই তার থাকবে। সেই গুণকে খোঁজার ধৈর্য রাখতে হবে। সেটিকে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। আর আচার-ব্যবহার দিয়ে তাকে বিচার করার আগে মনে রাখতে হবে, জিনের বৈশিষ্ট্যের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে বড় হয়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ।

মনোবিদদের পরামর্শ, ছোটবেলাতেই গল্পচ্ছলে দত্তক নেওয়ার বিষয়টি বাচ্চাকে জানিয়ে দেওয়া ভাল। ও বিষয়টিকে স্বাভাবিক মনে করেই বড় হয়ে উঠবে। দত্তক পরিচয় নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করতেও শেখাতে হবে।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিঃসন্তান দম্পতি শিশুকে দত্তক নেওয়ার পরে তাঁদের নিজেদের একটি বাচ্চা হল। কারণ, বাচ্চা দত্তক নেওয়ার পর তাঁদের সন্তানহীনতার মানসিক চাপের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে যায়। চাপমুক্ত মেলামেশার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের সন্তান আসে। তাই, পরিবারটি একাধিক সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারবে কি না, সেটি বুঝেই ‘কারা’-কর্মীরা প্রক্রিয়াটি এগোন।

এত দিক খেয়াল রেখে, সব রকম অবস্থার জন্য হবু অভিভাবক তৈরি কি না বুঝেই এখন সন্তানকামী মানুষদের শিশুর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে, ‘কারা’-র পদ্ধতিটিতে কিছুটা সময় লাগে। গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মোটামুটি ভাবে ১৮-২৪ মাস বা কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে আজীবন সন্তানের সঙ্গসুখের মুখ চেয়ে এটুকু অপেক্ষা তো করাই যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement