সন্তানের সব চাহিদায় হ্যাঁ নয়।
নতুন ক্লাস, সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে রিমি। তাই মা-বাবার কাছে বায়না, নতুন ফোন। তা পাওয়া যাচ্ছে না দেখে রাগারাগি শুরু হল মায়ের সঙ্গে। মা বলছেন, প্রতি বছর নতুন ফোন কিনে দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু নতুন ক্লাসের বন্ধুদের কী বলবে রিমি! তা ছাড়া, মা-বাবা নতুন চাকরি নিয়েই যে নতুন ফোন, ল্যাপটপ কিনল। রাগারাগি, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর, এ সব চলল কয়েকটা দিন। অবশেষে ইএমআই-এর ধাক্কা সামলাতে হবে জেনেও মেয়ের হাতে নতুন ফোন তুলে দিলেন মধুজা। সঙ্গে আক্ষেপ করলেন, ‘আমাদের সময়ে এমন ছিল না!’
এই পরিচিত ছবিটির মধ্যে তিনটি প্রবণতা লুকিয়ে রয়েছে:
এক, সন্তানকে স্নেহ, সময় না দিতে পারার ‘অপরাধবোধ’ থেকে অথবা স্রেফ আবদার মিটিয়ে ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে অভিভাবকেরা দামি জিনিসপত্র তুলে দিচ্ছেন। কখনও তার পছন্দের রেস্তরাঁয় ঘন-ঘন খেতে যাওয়া, ব্যয়বহুল জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, এ সবও চলে। একটা সময় দেখা যাচ্ছে, দৈনন্দিন কাজ পড়তে বসার জন্যও স্মার্টওয়াচ, ফোন এ সব চেয়ে বসছে খুদের দল। আর বায়না পূরণ না হলে এক দিকে, বাড়ির খুদে সদস্যটি অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কখনও-কখনও আবার অভিভাবকদের অপদস্থও করছে সে।
দুই, এই যে শিশুর ‘চাওয়া’ বা ‘অপদস্থ’ করার মধ্যে ঠিক-ভুলের ধারণাটি সে ভাবে কাজ করে না। কারণ, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কোনও ভাবে স্কুল বা বন্ধুবৃত্তের পরিবেশটির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। তার বন্ধুমহলে সে গুরুত্ব পাবে, এটাই তার চাহিদা।
তিন, ছবিটা থেকে স্পষ্ট, শিশুর চাওয়া আর অভিভাবকদের তার চাহিদা পূরণ, দু’টি ক্ষেত্রেই থাকছে জিনিসপত্র অর্থাৎ পণ্য। বিষয়টি নিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা হিয়া সেন বললেন, “এখনকার শিশু ও অভিভাবকদের মধ্যে ‘আরও বেশি’ পাওয়ার ইচ্ছেটা যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে নিত্যনতুন জিনিসের সহজলভ্যতা। কিন্তু অণু-পরিবারে দিনের বেশির ভাগ সময় একা কাটানো শিশুটির আবদার মেটাতে বা তার মন ‘ভাল’ করতে চাকরিজীবী মা-বাবা এই যে শুধুমাত্র জিনিসপত্রই তুলে দিচ্ছেন, তাতে বাড়ছে বিপদ। অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধু পরিসর বেছে নিতে শিশুটি নির্ভর করছে কত ভাল, কত দামি জিনিস, এমন একটি পরিমাপের উপরে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে, এই অভ্যস্ত জীবনযাপনটিতে যখনই বাধা আসছে বলে মনে করছে শিশু-মন, তখনই বাড়ছে অস্থিরতা।
উপায় কী?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম জানাচ্ছেন, পরিবার, বন্ধু, পড়শি, সব কিছুরই প্রভাব পড়ে শিশু-মনে। বাড়ির বড়রা যদি নিজেদের ভাল থাকাটা কতটা দামি জিনিস তাঁর কাছে আছে, এটা দিয়ে নির্ধারণ করেন, তা হলে শিশু-মনও সে শিক্ষাই পাবে। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের জন্য জয়রঞ্জনের পরামর্শ—
শিশুদের বোঝাতে হবে, সকলের পক্ষে সব ধরনের খরচ করা সম্ভব নয়। কোনও এক বার দামি রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া বা ব্যয়বহুল কোনও জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার অর্থ ঘন-ঘন সেটাই হবে, এই ধারণাটা ভুল।
ছোট থেকেই জিনিসের মূল্য বুঝতে শিখলে, জীবনের মূল্যবোধ তৈরি হলে, ভবিষ্যতে সে সব রকমের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখবে। একই সঙ্গে অভিভাবকদেরও নিজেদের সংযত রাখা জরুরি। কারণ, তা হলেই সে শিক্ষাটা শিশু পাবে।
কোনও কিছু না পাওয়া বা তা কষ্ট করে অর্জন করার মূল্য শিশুটিকে বুঝতে দিতে হবে। আর তাই তার কোনও সাফল্যের জন্য উপহার বাছাই এবং ব্যর্থতায় শাসন, কোনওটাই মাত্রাছাড়া হলে চলবে না।
অনেক সময়ে, শিশুদের সহজেই দামি জিনিস পাওয়াটা অভ্যেস হয়ে যায়। তারা ভাবে, এক বারে না পাওয়া গেলে, বার বার চেয়ে, জেদ করে, জিনিসপত্র ভেঙে তা পাওয়া যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দামি জিনিসটি না পেলেই বাচ্চারা নিজেদের ক্ষতি করতে পারে, এমন দুশ্চিন্তায় থাকেন অনেক অভিভাবকই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মত, প্রথমেই শিশুর আবদারকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। আর কোনও একটি উপহার না পেলে নিজের ক্ষতি করতে পারে শিশুরা, এমনটা সচরাচর হয় না। অনেক চাপা ক্ষোভ, স্নেহের অভাব আর মানসিক কষ্ট থেকেই নিজের ক্ষতির চিন্তা করে বাচ্চা থেকে বড়, সকলেই।
দামি উপহারের চেয়েও সন্তানকে অভিভাবকদের সময় দেওয়াটা অনেক দামি। দিনভর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে অপরাধবোধ থেকে দামি উপহার দেওয়ার চেষ্টা না করাই ভাল। বরং, খুদেটিকে সময়, জিনিস ও স্নেহের মূল্য বোঝানোর চেষ্টা করা জরুরি।