Mental Health

গান-শিল্পে নিজেদের পথ চলার গল্প বললেন আবাসিকেরা, প্রথম জন্মদিন পালন করল ‘প্রত্যয়’

মনোরোগ থেকে সেরে ওঠা মানুষদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী ‘প্রত্যয়’। শুক্রবার সেই ‘প্রত্যয়’-এ বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন হল। শুভাকাঙ্ক্ষী ও স্বজনদের নিয়ে করা হয়েছিল আনন্দ-আয়োজন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ ২০:০৮
Share:

‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকদের তৈরি ইনস্টলেশন। তাঁদের সঙ্গে মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় এবং শিল্পী শ্রীকান্ত পাল। — নিজস্ব চিত্র।

সংসারে তো ছিলেনই। জীবন বদলে দিয়েছে মনোরোগ। রোগ সারলেও ঘরে ফেরা হয়নি। হয়নি কি? না কি ঘরের মানে বদলে গিয়েছে? এক সময়ে বছর বছর কেটেছে লুম্বিনী পার্ক কিংবা পাভলভ হাসপাতালে। মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেলেও সমাজের ছুতমার্গ হয়তো পিছু ছাড়েনি। তাই নিজের বাড়ি ফেরা হয়নি। তাঁদের জন্যই নতুন সংসার পাতা হয়েছে। হয়েছে নতুন ঘর। মানসিক রোগ থেকে সেরে ওঠা সেই ব্যক্তিদের জন্য তৈরি হয়েছে ‘প্রত্যয়’। এখন আবাসিকেরা হয়ে উঠেছেন একে অপরের কাছের মানুষ। আর এমন ‘নতুন দেশে’ এসে পথ চলার এক বছর পূর্ণ করেছেন তাঁরা। শুক্রবার সেই ‘প্রত্যয়’-এ বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন হল। শুভাকাঙ্ক্ষী ও স্বজনদের নিয়ে করা হয়েছিল আনন্দ-আয়োজন।

Advertisement

‘প্রত্যয়’- এর আবাসিক ভাস্কর মিত্রের গানের সঙ্গে গলা মেলালেন শিল্পী স্যমন্তক সিংহ। —নিজস্ব চিত্র।

মনোরোগ থেকে সেরে ওঠা মানুষদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী ‘প্রত্যয়’। গত এক বছরে বন্ডেল রোডের ঠিকানাই তাঁদের বাড়ি হয়ে উঠেছে রাজ্য সরকার ও ‘অঞ্জলি’-র চেষ্টায়। সেই বাড়িতেই গত এক বছরের যাত্রার গল্প বললেন আবাসিকেরা। অনুষ্ঠানের থিম ‘এলেম নতুন দেশে’। এই নতুন ঘর-বাড়ি, পরিবার নিয়ে কী ভাবে কাটল জীবন, তা-ই শিল্পের মাধ্যমে বলল ‘প্রত্যয়’। নাচ-গান যেমন হল, তেমনই রইল আবাসিকদের তৈরি ইনস্টলেশনের প্রদর্শনী। বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, সমাজের নানা স্তরের মানুষ এসে দেখলেন সে কাজ। আবাসিক ভাস্কর মিত্রের গানের সঙ্গে গলা মেলালেন শিল্পী স্যমন্তক সিংহ। গান গাইলেন গায়ক-পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও। আবার ‘প্রত্যয়’-এর অনেককে নিয়ে নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন স্মৃতিপর্ণা সেনগুপ্ত। শুক্রবারের প্রধান অতিথি ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব মলয়কুমার দে। তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন স্বাস্থ্য দফতরে এসেছিলাম, তখন জানা ছিল না যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এত বড়। সে সময় আর এ সময়ের মধ্যে অনেকটা তফাত। এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। পুরনো অবস্থা যে কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে, সেটাই অনেক বড় ব্যাপার। তাই আজ এখানে এসে সবটা দেখে খুব ভাল লাগছে।’’

‘প্রত্যয়’- এর আবাসিকদের সঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব মলয়কুমার দে। —নিজস্ব চিত্র।

বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি চলেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। ‘প্রত্যয়’-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায় জানান, নতুন ঘর, পরিজন পাওয়া এবং অনেক না-পাওয়ার গল্প নিয়েই ইনস্টলেশন তৈরি করা হয়েছে। নেতৃত্ব দিয়েছেন শিল্পী শ্রীকান্ত পাল। সঙ্গ দিয়েছেন অলক হালদার এবং অনিতেশ চক্রবর্তী। অবাসিকদের জীবন থেকে স্বপ্ন, নানা ভাবে শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে। শ্রীকান্ত এবং অনিতেশ আনন্দবাজার অনলাইনকে জানান, আবাসিকদের রোজের জীবনের নানা কথাই তুলে ধরা হয়েছে তাঁদের ইনস্টলেশনে। তাঁদের ব্যবহারের জিনিসপত্র যেমন আছে, তেমন শব্দের ব্যবহারও হয়েছে সে ভাবেই। অনিতেশ বলেন, ‘‘ইনস্টলেশনে এমন কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, যার যোগাযোগ নেই প্রত্যয়ের আবাসিকদের জীবনের সঙ্গে।’’ তাঁদের রোজের যাপন কেমন, তা যাতে ফুটে ওঠে, সেটিই এই কাজের মূল ভাবনা।

Advertisement

‘প্রত্যয়’- এর বাড়ি সেজেছে আবাসিকদের কাজে। —নিজস্ব চিত্র।

অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার কাজে আবাসিকদের উৎসাহ দেখে খুশি ‘অঞ্জলি’-র কর্মকর্তা মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। মূলধারায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আবাসিকদের সব সময়েই নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে অনুপ্রাণিত করেন তিনি। পুতুল বানানোর কর্মশালা থেকে চলচ্চিত্র উৎসব— আবাসিকদের নিয়ে সারা বছর নানা ধরনের কাজ চলে ‘প্রত্যয়’-এ। রত্নাবলী বলেন, ‘‘সক্ষম সমাজ যদি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করার গুরুত্বটুকুও দেয়, বেশির ভাগ সময়েই উত্তর থাকে না। কারণ, প্রশ্নকর্তাকে এটা বোঝানো মুশকিল হয়, যে স্বাভাবিকতার বোধ থেকে প্রশ্নগুলো তিনি করছেন, আর এই মানুষগুলোর দৈনন্দিনতা, দুটো অনেকটাই আলাদা। প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দাবি থাকে। অনেক সময় সেটা যথেষ্ট প্রকটও বটে। আগে স্বাভাবিকতার তূল্যমূল্যতায় এসো, তার পরে কথা হবে।’’ প্রত্যয়ের আবাসিকেরা তাঁদের এই প্রদর্শনীতে এই অভিজ্ঞতাগুলোকে সংহত করে, তাঁদের জবাবগুলো দিয়েছেন, তাঁদের মতো করে। শ্রীকান্ত, অলক, অনিতেশরা সেটা তৈরি করতে ওঁদের সাহায্য করেছেন বলে বক্তব্য রত্নাবলীর। তিনি আরও বলেন, ‘‘বর্ষপূর্তির এই অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের এই এক বছরের পরিক্রমাকে ধরতে চেয়েছি। ক্রমাগত অপরায়ন থেকে একটা প্রান্তিক পরিচিতির মানুষ কী ভাবে মূলধারার সমাজের মুখোমুখি হন, সেটাই মূল বিষয়। কেউ প্রামাণ্যতার দায় চাপিয়েছেন, সক্ষম সমাজে অন্তর্ভুক্তির শর্ত চাপিয়েছেন। এই মানুষগুলো কী চান, তাঁদের মতামতের তোয়াক্কা করতে চাননি। সেটাই অবশ্য সব নয়। কেউ কেউ সহৃদয় ভাবে কাঁধে হাত রেখেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। কিন্তু এখনও অবধি সেগুলো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি অভিজ্ঞতা বলাটাই ঠিক হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement