পা কাটা রোগীকে ফেরাল পিজি ও ন্যাশনাল

ট্রেনের ধাক্কায় ডান পা গোড়ালির একটু উপর থেকে কাটা পড়েছে। মাথা ফাটা, শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে ফালাফালা। মঙ্গলবার সকালে রক্তে ভেসে যাওয়া সেই যুবক আর তাঁর কাটা পা নিয়ে খাস কলকাতা শহরের এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে আর এক মেডিক্যাল কলেজে ন’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দৌড়ে বেড়ালেন বন্ধুরা। কিন্তু কোথাও তাঁকে ভর্তি নেওয়া তো দূরে থাক, ন্যূনতম স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক বা রক্ত পর্যন্ত দেওয়া হল না। অভিযোগ, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা ইমার্জেন্সিতে নাম-কা-ওয়াস্তে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললেন, “গুরুতর কেস। অন্য কোথাও নিয়ে যান!”

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১২
Share:

হাসপাতালের শয্যায় শেখ মরফুত।

ট্রেনের ধাক্কায় ডান পা গোড়ালির একটু উপর থেকে কাটা পড়েছে। মাথা ফাটা, শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে ফালাফালা। মঙ্গলবার সকালে রক্তে ভেসে যাওয়া সেই যুবক আর তাঁর কাটা পা নিয়ে খাস কলকাতা শহরের এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে আর এক মেডিক্যাল কলেজে ন’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দৌড়ে বেড়ালেন বন্ধুরা। কিন্তু কোথাও তাঁকে ভর্তি নেওয়া তো দূরে থাক, ন্যূনতম স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক বা রক্ত পর্যন্ত দেওয়া হল না।

Advertisement

অভিযোগ, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা ইমার্জেন্সিতে নাম-কা-ওয়াস্তে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললেন, “গুরুতর কেস। অন্য কোথাও নিয়ে যান!” আবার এসএসকেএমে চার ঘণ্টা ধরে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকা, রক্তে ভেসে যাওয়া ওই রোগীকে চিকিৎসকেরা এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে ঘুরিয়ে তার পরে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে আউটডোরে দেখানোর পরামর্শ দেন বলে অভিযোগ। অসহায়, দিশাহারা রোগীর বন্ধুরা তা-ও করলেন। তার পরেও আউটডোরে ওই রোগীর টিকিটে লিখে দেওয়া হয়, “দুঃখিত, বেড দেওয়া যাচ্ছে না।”

রক্তপাত ও যন্ত্রণায় ক্রমশ নেতিয়ে পড়া ২৬ বছরের যুবক শেখ মরফুতকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত সঙ্গীরা যান টালিগঞ্জের এমআর বাঙুর হাসপাতালে। যেহেতু সেটি মেডিক্যাল কলেজ নয়, তাই সেখানে প্লাস্টিক সার্জারি বা ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ নেই। তা সত্ত্বেও যুবকটির অবস্থা এবং মারাত্মক রক্তক্ষরণ দেখে বাঙুরের চিকিৎসকেরা তাঁকে ভর্তি করে নেন। প্রেশার ব্যান্ডেজ করে রক্ত বন্ধ করা হয়। স্যালাইন আর পাঁচ বোতল রক্ত দেওয়া হয় ওই যুবককে।

Advertisement

স্তম্ভিত বাঙুরের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভোর সাড়ে পাঁচটায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, আর দুই মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে রোগীকে যখন বাঙুরে আনা হল, তখন দুপুর আড়াইটে। তখনও পর্যন্ত সাধারণ গজ-ব্যান্ডেজ ছাড়া ওই রোগীর কোনও চিকিৎসাই হয়নি। হুহু করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। রোগী হুঁশে থাকলেও যন্ত্রণায় চিৎকারের ক্ষমতা নেই। শুধু থরথর করে কাঁপছে। পাল্স প্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। যুবক বলে বেঁচে গেল। শিশু বা বৃদ্ধ হলে রাস্তাতেই সম্ভবত মারা যেত।”

স্বভাবতই এই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠেছে, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্য ট্রমা কেয়ার নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের এত বড় বড় ঘোষণার ফল কী হল? খাস কলকাতায় যদি পা কেটে বাদ হয়ে যাওয়া রোগীকে আউটডোরে লাইন দিয়ে তার পরে শুনতে হয় ‘বেড নেই’, তা হলে জেলায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে কী অবস্থা হবে? এ ছাড়া, দিন কয়েক আগেই নতুন করে ‘রেফারল’ পদ্ধতি সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। সেখানে বলা হয়েছে, গুরুতর অসুস্থকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রেফার করা হলে যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে হাসপাতালকে। এ ছাড়া, যে হাসপাতালে রেফার হচ্ছে, সেখানে ফোন করে সব ব্যবস্থা করে রাখতে বলা হবে। সেই নিয়মেরই বা কি হল? নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা নজরদারির কী ব্যবস্থা স্বাস্থ্য দফতরের আছে?

স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “এত বড় সিস্টেমে এই নজরদারি সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষেরা নজর না দিলে স্বাস্থ্য ভবনের পক্ষে তা দেখা অসম্ভব।” মরফুতের ঘটনা জেনে ক্ষুব্ধ সুশান্তবাবু অবশ্য মন্তব্য করেছেন, “এ কোথায় যাচ্ছি আমরা? আর কত শেখাব চিকিৎসকদের? তাঁদের কি কোনও মানবিকতা অবশিষ্ট নেই? পা কেটে বাদ যাওয়া রোগীকে আউটডোরের লাইনে দাঁড়াতে বলছে! মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরের।”

এসএসকেএমের আউটডোরের সেই টিকিট। নিজস্ব চিত্র

দুপুরে এমআর বাঙুর হাসপাতালের যে শয্যায় মরফুত শুয়েছিলেন, তার চাদর তখনও রক্তে লাল। সবেমাত্র রক্তক্ষরণ থেমেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। তার মধ্যেই তিনি কোনও রকমে জানালেন, মুর্শিদাবাদের লালগোলা থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে কলকাতায় এসেছিলেন। সোমবার পার্ক সার্কাস রেললাইনের ধারে এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ প্রাতঃকৃত্য সারতে রেললাইনের ধারে যান। অন্ধকারে আর ঘুমের ঘোরে খেয়াল করেননি ট্রেন আসছে। ট্রেনের ধাক্কায় পড়ে যান। আর চোখের সামনে কেটে যায় পা। কিন্তু ওই অবস্থাতেই তিনি নিজের মোবাইল থেকে ফোন করে বন্ধুকে ডাকেন। স্থানীয় ছেলেদের সাহায্যে একটি ভ্যান জোগাড় করে তাঁর দুই বন্ধু মুকুল শেখ আর কবিরুল শেখ ন্যাশনাল মেডিক্যালে রওনা হন। তার পরই হেনস্থার শুরু।

মুকুল বলেন, “ন্যাশনালে ইমার্জেন্সির চিকিৎসকেরা আমাদের কোনও মতে তাড়াতে পারলে বাঁচেন। শুধু বলছিলেন, ‘এসএসকেএমে চলে যান। এখানে কিছু হবে না।’ ২৩০০ টাকা অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া দিয়ে এসএসকেএমে পৌঁছই সকাল আটটা নাগাদ। তার পরে আমাদের দিয়ে চার ঘণ্টা শুধু দৌড় করালেন ডাক্তারবাবুরা। কখনও এক্স-রে, কখনও ইসিজি করতে লাইন দিচ্ছি।” কবিরুল ওই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “স্ট্রেচারে শুয়ে মরফুত চিৎকার করছে, স্ট্রেচার চুঁয়ে রক্তের ধারা বইছে। আমরা সেই স্ট্রেচার বয়ে কখনও এই বিল্ডিং, কখনও ওই বিল্ডিং দৌড়চ্ছি। কোনও ডাক্তার এক বার ছুঁয়েও দেখছেন না রোগীকে। তার উপরে বলছেন ওই রোগী নিয়ে আউটডোরে লাইন দিতে!”

তার পরের ঘটনা বললেন মরফুত নিজেই। “আউটডোরের লাইনে স্ট্রেচার রাখা। ব্যথায় আমার চার দিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আর পারব না। এ বার জান বেরিয়ে যাবেই। ডাক্তার আর আসছেন না। এক ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত সাড়ে দশটা নাগাদ ভিতরে ডাকলেন। তার পরে জানিয়ে দিলেন, বেড হবে না। কবিরুল আর মুকুল হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। তা-ও আমাকে ভর্তি করল না।”

কেন এই কাজ করলেন এসএসকেএমের অর্থোপেডিক ১ ইউনিটের ডাক্তারেরা? হাসপাতালের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের কথায়, “অর্থোপেডিক বিভাগ নিয়ে আমরা বিব্রত, বীতশ্রদ্ধ। এমসিআই-এর কাছেও ওদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। কোনও নিয়ম মানছে না, কাজ করছে না, একের পর এক অভিযোগ আসছে। এ বার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে।” আর ন্যাশনাল মেডিক্যাল নিয়ে কী যুক্তি দিচ্ছেন সেখানকার সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী?

সুপারের বক্তব্য, “আমাদের এখানে মাত্র এক জন কার্ডিওভাসকুলার সার্জন। তার পক্ষে এত জটিল কেস একা সামলানো সম্ভব নয়।” তা বলে এই রোগীকে ভর্তি করে স্যালাইনটুকু দেবেন না? সুপারের জবাব, “এটা নিয়ে আপনারা লিখে দিন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement