অবদান তিন বাঙালিরও

ক্যানসার-যুদ্ধে নির্ভুল লক্ষ্যভেদের বড় দিশা দিল গবেষণা

এক রোগ, একই চিকিৎসা। অথচ পৃথক ফল! এমন নজির আকছার সামনে আসে। বিশেষত ক্যানসারের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, একই কেমোথেরাপি নেওয়া দুই ক্যানসার-রোগীর এক জন হয়তো বেশ ক’বছর দিব্যি সুস্থ জীবন কাটিয়ে দিলেন। অথচ অন্য জনের মৃত্যু ঘনিয়ে এল কয়েক মাসের মধ্যে!

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৩৩
Share:

বিশ্বনাথ মজুমদার, প্রদীপ মজুমদার ও শিলাদিত্য সেনগুপ্ত।

এক রোগ, একই চিকিৎসা। অথচ পৃথক ফল!

Advertisement

এমন নজির আকছার সামনে আসে। বিশেষত ক্যানসারের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, একই কেমোথেরাপি নেওয়া দুই ক্যানসার-রোগীর এক জন হয়তো বেশ ক’বছর দিব্যি সুস্থ জীবন কাটিয়ে দিলেন। অথচ অন্য জনের মৃত্যু ঘনিয়ে এল কয়েক মাসের মধ্যে!

এবং এই ‘বৈষম্যের’ জন্য ক্যানসারের বিচিত্র চরিত্রকেই দায়ী করে থাকেন বিশেষজ্ঞেরা। ওঁদের বক্তব্য, ক্যানসারের প্রতিটা টিউমার আলাদা আলাদা রকমের। তাই সেগুলোকে বাগে আনতেও আলাদা আলাদা চিকিৎসা বা ওষুধ দরকার। কিন্তু কোন রোগীর উপরে কোন ওষুধ ঠিকঠাক কাজ করবে, তা আগে বোঝা যাবে কী করে?

Advertisement

বস্তুত ক্যানসার চিকিৎসায় সাফল্যলাভের পথে এই সমস্যাটি মস্ত বড় অন্তরায়। সম্প্রতি তা থেকে মুক্তির দিশা দেখা দিয়েছে। দিয়েছেন বিশ্বের সাতটি প্রতিষ্ঠানের ২৩ জন বিজ্ঞানীর একটি দল, যাঁদের মধ্যে তিন জন বাঙালি। ওঁঁরা দেখিয়েছেন, কী ভাবে ক্যানসার-টিউমারের অংশকে শরীরের বাইরে এনে তার উপরে ওষুধ প্রয়োগ করে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া যায়, কোন ওষুধটি কার্যকর হবে, আর কোনটা নয়। পুরো প্রক্রিয়াটির পোশাকি নাম ‘ক্যান্সস্ক্রিপ্ট।’

শুক্রবার আম্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গিয়েছে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক মহলে। তাঁরা বলছেন, ওষুধের কার্যকারিতা আগাম নিশ্চিত করা গেলে রোগীর আয়ুু যেমন বাড়বে, তেমন ওষুধের ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে বিপুল টাকার অপচয়ও রোখা যাবে।

গবেষণা-দলের তিন বাঙালি বিজ্ঞানী হলেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সহকারী অধ্যাপক শিলাদিত্য সেনগুপ্ত, বেঙ্গালুরুর এক গবেষণা সংস্থার অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর বিশ্বনাথ মজুমদার এবং ওই সংস্থারই চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার প্রদীপ মজুমদার। ওঁদের কাজ ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্যানসার-চিকিৎসকদের প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছে। ওঁদের গবেষণাপত্রের বক্তব্য: ক্যানসার চিকিৎসায় যাবতীয় জটিলতার মূলে রয়েছে টিউমারের সীমাহীন বৈচিত্র্য। যে কারণে ক্যানসারের ‘অণু-পরিবেশ’ (মাইক্রো এনভায়রনমেন্ট) সদা পরিবর্তনশীল। এই কারণেই প্রতিটি রোগীর টিউমার আলাদা আলাদা। এ হেন ধুরন্ধর শত্রুর মোকাবিলা করতে গেলে বিকল্প অস্ত্র প্রয়োজন। কী সেই বিকল্প?

বিশ্বনাথবাবু এ দিন বলেন, ‘‘টিউমারের বিশেষ অংশকে রোগীর দেহের বাইরে এনে তার উপরে ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। এতে বোঝা যাবে, টিউমারটিকে দমাতে কোন ওষুধ কার্যকর হবে, কোনটা হবে না।” বিশ্বনাথবাবু জানিয়েছেন, বিশেষ ধরনের টিউমারবাহী ইঁদুর ছাড়াও অস্ত্রোপচার বা নিড্ল বায়পসির মাধ্যমে শতাধিক রোগীর টিউমার বাইরে এনে এই পরীক্ষা চালিয়ে সাফল্য মিলেছে। প্রসঙ্গত, টিউমারের অংশকে শরীরের বাইরে এনে বড় জোর তিন দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো যায়। গবেষকেরা বলছেন, ল্যাবরেটরি যত আধুনিকই হোক না কেন, তিন দিন বাদে টিউমারের সজীবতা নষ্ট হতে শুরু করে।

তবে পরীক্ষাটি যদি সফল ভাবে করা যায়, তা হলে রোগ মোকাবিলার সঠিক অস্ত্র হাতে পাওয়া অনেক সহজ হবে বলে বিশ্বনাথবাবুর দাবি। তিনি জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট একটি টিউমারে কোন কোন ওষুধ একেবারে কার্যকরী হবে না, এই পরীক্ষায় তা একশো ভাগ নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া সম্ভব। কোন ওষুধ কাজ করবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় ৮৫-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে। আবিষ্কারটিকে ‘যুগান্তকারী’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন তিনি।

‘ক্যান্সস্ক্রিপ্ট’ বেঙ্গালুরুতে পরীক্ষামূলক ভাবে চালু হয়ে গিয়েছে। প্রদীপবাবু জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাজ্যের রোগীদের নিয়ে তাঁরা পরীক্ষা চালিয়েছেন। “ওঁদের মধ্যে কলকাতার রোগীও ছিলেন। ওঁদের টিউমারের অংশ বিশেষ ভাবে সংরক্ষণ করে বিমানে বেঙ্গালুরুর ল্যাবে নিয়ে আসা হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসাও শুরু হয়েছে।” বলেন তিনি। প্রদীপবাবুদের আশা, স্বীকৃতি পেয়ে গেলে অন্য জায়গাতেও ‘ক্যান্সস্ক্রিপ্ট’ শুরু করা কঠিন হবে না।

আশায় রয়েছেন অন্য গবেষক-চিকিৎসকেরাও। কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)-এর অধিকর্তা জয়দীপ বিশ্বাসের কথায়, “ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা পার্সোনালাইজড ক্যানসার চিকিৎসার চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ক্যান্সস্ক্রিপ্টের মতো পদ্ধতিতে ওষুধের কার্যকারিতা আগাম জেনে নেওয়া গেলে কম খরচে যথাযথ চিকিৎসা অনেকটা নিশ্চিত করা যাবে।” সিএনসিআই-এর বিজ্ঞানী নবেন্দু মূর্মুও চিকিৎসার খরচ কমানোর উপরে জোর দিচ্ছেন। “যে কোনও গবেষণার সাফল্য অনেক বড় চেহারা নেয়, যদি তা সাধারণ মানুষের শারীরিক কষ্ট ও আর্থিক বোঝা কমাতে পারে। এ ক্ষেত্রে দু’টোই হওয়া সম্ভব।” মন্তব্য নবেন্দুবাবুর। ক্যানসার সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, “একই ওষুধের নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া আকছার দেখছি। কেমোথেরাপি কাজে না লাগায় রোগী ও তাঁর পরিজনেরা কী ভাবে হতাশায় ডুবে যান, তা-ও দেখছি। এমন একটা পদ্ধতি চালু করা গেলে নিঃসন্দেহে উপকার হবে।”

সংশয়ের সুরও যে নেই, তা নয়। যেমন শোনা গিয়েছে ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে। যিনি বলছেন, “ওষুধের প্রতিক্রিয়া ল্যাবরেটরিতে আর শরীরের ভিতরে সব সময়ে এক হয় না। তাই খুব আশান্বিত হওয়ার আগে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করা দরকার।” ভারতের মতো দেশে এই জাতীয় পরীক্ষার খরচ বহন করা ক’জনের সাধ্যে কুলোবে, তা নিয়েও ওঁর মনে যথেষ্ট সন্দেহ।

বেঙ্গালুরুতে পরীক্ষামূলক ভাবে যেটুকু চালু হয়েছে, তাতে কত খরচ পড়ছে?

বিশ্বনাথবাবু জানান, ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। তবে তাঁর বক্তব্য, ব্যাপক ভাবে চালু হলে স্বভাবতই খরচ অনেকটা কমে আসবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement