বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন স্ত্রীরোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি
Women Health

স্ত্রীরোগের খুঁটিনাটি

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত এবং ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বয়ঃসন্ধিকালে অধিকাংশ সমস্যা হয় ঋতুস্রাবের কারণে।

Advertisement

কোয়েনা দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৩ ০৮:১৬
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছে পিউ। শুরু হয়েছে ঋতুস্রাব। তবে তা বেশ অনিয়মিত। দু’-চার মাস পরপর হয়। পিহুর বন্ধু রাকার আবার সমস্যা ব্যথা। পিরিয়ডস হলেই ওর তলপেট ও কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। শালিনীর বয়স প্রায় ৩০। গত দু’বছর ধরে বারেবারে চেষ্টা করলেও মা হতে পারছেন না তিনি। ক্রমশ হতাশ হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। সুবলা দেবীর বয়স ৪৮। দুই সন্তানের মা। মেনোপজ়় হলেও প্রস্রাবের সময় মাঝে মাঝেই জ্বালা করে।

Advertisement

বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা

বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন স্ত্রীরোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে, বিষয়টি সহজ হয়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত এবং ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বয়ঃসন্ধিকালে অধিকাংশ সমস্যা হয় ঋতুস্রাবের কারণে।

Advertisement
  • ঋতুস্রাবে দেরি: পিরিয়ডস শুরুর কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। শারীরিক ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপরে নির্ভর করে বিভিন্ন বয়সে পিরিয়ডস শুরু হতে পারে। তবে ১১ বছরের পরেও যদি পিরিয়ডস শুরু না হয়, তবে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। ১৪ বছর বা তার পরেও অনেকের ঋতুস্রাব শুরু হয়। জন্মগত ভাবে কখনও অনেকের শরীরে ইউটেরাসের অনুপস্থিতির কারণেও পিরিয়ডস না হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভাল।
  • অনিয়মিত ঋতুস্রাব: পিরিয়ডস শুরু হওয়ার পরও অনেক সময়েই তা অনিয়মিত হয়। এর মূল কারণ অপরিণত ডিম্বাশয়। অ্যানওভিউলেটরি সাইকেলের কারণে অনেক সময়েই পিরিয়ডস অনিয়মিত হয়। ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্তের মতে, এই ঘটনা বেশ স্বাভাবিক। এতে ভয় বা দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
  • ডিসমেনোরিয়া: এই বয়সে পরিচিত আরও একটি সমস্যা হল ডিসমেনোরিয়া। এতে পিরিয়ডসের সময় শরীরের নিম্নাঙ্গের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা হয়। বয়ঃসন্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সেই এই সমস্যা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা স্বাভাবিক হলেও, কখনও কখনও তার গুরুতর কারণও থাকে। এর মধ্যে রয়েছে এন্ডোমেট্রিয়োসিস বা ফাইব্রয়েড এন্ডোমেট্রিয়োসিস ইত্যাদি। তবে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আলট্রাসোনোগ্রাফি সহ নানা পরীক্ষা করে প্রথমেই ব্যথার কারণ নির্ধারণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমেই এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  • সিস্ট: বয়ঃসন্ধিতে ডিম্বাণুতে অনেক সময়ে পলিকিউলার বা ফিজিওলজিক্যাল সিস্টও তৈরি হয়। সাধারণ ভাবে এর কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। সময়ের সঙ্গে এই সিস্ট চলে যায়। তবে সিস্টের কারণে ব্যথা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • সাদাস্রাব: সাদা স্রাবের সমস্যাও খুবই সাধারণ ঘটনা। বয়ঃসন্ধিকালে এই সমস্যা একটু বেশি হতে পারে। পেলভিক, ভ্যাজাইনাল বা তলপেটে ইনফেকশনের কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা, ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত ঠিক হাইজিন অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
  • রোমের প্রাচুর্য: পাশাপাশি ডা. অভিনিবেশ বলেন অল্প বয়সে হরমোনের ভারসাম্যের অভাবের কারণে অনেকেরই মুখে অবাঞ্ছিত রোমের প্রাচুর্য দেখা যায়। বয়স বাড়লে সেই সমস্যা মিটে যায়।

প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণ সমস্যাসমূহ

  • পিসিওএস: কিছু সমস্যা বয়ঃসন্ধির পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদেরও হতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হল সিস্টের সমস্যা। পিসিওএস অর্থাৎ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম নামটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। মূলত এটি একটি হরমোনের সমস্যা। সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিয়মিত জাঙ্ক ফুডও এই রোগের অন্যতম কারণ। বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়েই মূলত এই সমস্যা দেখা দেয়। এর কারণে দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি শরীরেও নানা গাইনিকলজিক্যাল সমস্যা তৈরি হয়। ওষুধ তো বটেই, সঙ্গে জীবনযাপনে বদল আনার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। প্রয়োজনে কখনও অস্ত্রোপচারও করতে হতে পারে।
  • ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড: বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে গিয়ে অনেকের এই সমস্যা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড থাকা কিন্তু ভয়ের বিষয় নয়। ছোট্ট এই মাসল তেমন ক্ষতিকর নয়। তবে কখনও এই ফাইব্রয়েডের কারণে ব্যথা, রক্তপাত, প্রস্রাবে সমস্যা কিংবা ইনফার্টিলিটি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
  • বন্ধ্যাত্ব: ইনফার্টিলিটি নানা কারণে হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন যেমন – ধূমপান, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি প্রাথমিক ভাবে বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। এ ধরনের কারণগুলি নিরাময়যোগ্য। পাশাপাশি হরমোনের ভারসাম্যের অভাব ও অন্যান্য নানা গুরুতর কারণেও বন্ধ্যাত্ব আসতে পারে। সমস্যা থাকতে পারে ফেলোপিয়ান টিউবেও। এ ক্ষেত্রে আজকাল নানা চিকিৎসা রয়েছে।

বয়সকালের নানা সমস্যা

  • মেনোপজ়়: সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে ঋতুচক্র স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়ে মেনোপজ়় হয়৷ অনেক ক্ষেত্রেই মহিলারা এই সময় হট ফ্লাশ, কোল্ড ফ্লাশের শিকার হন৷ অতিরিক্ত ঘামও হয় অনেক মহিলার৷ মেনোপজ়় এগিয়ে এলে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেসের অভিজ্ঞতা হয় অনেকেরই৷ ব্লাডার নিয়ন্ত্রণও ক্ষীণ হয়ে আসে৷ তা ছাড়া, চুল পড়ে যাওয়া, ত্বকের রুক্ষতা, ওজন বাড়া, অবসাদ, মাথাব্যথা, স্মৃতিশক্তি বিঘ্নিত হওয়ার মতো উপসর্গও অনেক সময়ে দেখা যায়। ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্তের মতে, আমাদের দেশে মহিলাদের স্বাস্থ্যের অন্যান্য দিকের সঙ্গে মেনোপজ়়ও উপেক্ষিত। অনেক ক্ষেত্রে এই উপসর্গ পরে জটিল আকার ধারণ করতে পারে৷ তাই মেনোপজ়় সংক্রান্ত কোনও উপসর্গ দেখাদিলে বা মেনোপজ়় শুরু হলেস্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
  • প্রোল্যাপ্স: মেনোপজ়়ের পরে অনেকের ইউটেরাস ও ডিম্বাশয়ের পেশিগুলি দুর্বল হয়ে ইউটেরাসের স্থানচ্যুত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অপারেশনের পাশাপাশি এই সময় নানা পেলভিক ব্যায়ামের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

গাইনিকলজিক্যাল ক্যানসার

  • ইউটেরাস ক্যানসার: ডা. অভিনিবেশের মতে, বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে বেশি থাকে ক্যানসারের ঝুঁকি। মেনোপজ়়ের পরেও কখনও রক্তপাত হয়। সে ক্ষেত্রে কখনও ইউটেরাসে ক্যানসারের সম্ভাবনা থেকে যায়। যদিও এর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। মেনোপজ়়ের আগেও এই ধরনের ক্যানসার হতে পারে। তবে তুলনামূলক ভাবে এই ক্যানসারে ভয় অনেকটাই কম।
  • স্তন ক্যানসার: এ ছাড়াও এই বয়সে থাকে স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা। বয়সের পাশাপাশি অনেকসময়েই বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় লক্ষণগুলিকে অবজ্ঞা করায় বিষয়টি গুরুতর হয়ে যায়।
  • সারভাইকাল ক্যানসার: ৩৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে সারভাইকাল ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অস্বাভাবিক রক্তপাত, ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ এর লক্ষণ। তবে একটু সচেতন হলে এখন এই সমস্যা এড়ানো যায়। ২৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে নিয়মিত নির্দিষ্ট সময় অন্তর যদি সারভাইকাল প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষাটি করা হয়, সে ক্ষেত্রে বিপদ এড়ানো প্রাথমিক ভাবেই সম্ভব হয়। সারভাইকাল ক্যানসারের ভ্যাকসিনও রয়েছে। ১০ থেকে ৪৫ বছর অবধি এই ভ্যাকসিন দেওয়া যায়।
  • ওভারিয়ান ক্যানসার: বেশি বয়সে হয় সাধারণত। এই ক্যানসারে পেট ফোলা, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি নন-গাইনিকলজিক্যাল লক্ষণ দেখা যায়। একে সাইলেন্ট কিলার বলা হয়। তবে ওভারিয়ান ক্যানসার অনেকটাই জিনগত সমস্যা। তাই পারিবারিক ইতিহাসে এই রোগ থাকলে, সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

বয়ঃসন্ধির পর থেকেই প্রতিটি মেয়ের স্বাস্থ্যের দিকে নিয়মিত নজর রাখা প্রয়োজন। আপাত ভাবে সমস্যা না থাকলেও দু’ থেকে তিন বছর অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি। পাশাপাশি শরীরে সামান্য অসুবিধে, কোনও লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সঙ্গে স্বাস্থ্যকর ডায়েট, ব্যায়াম এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement