ক্যানসার যখন ধরা পড়ল, তখনই তা চতুর্থ পর্যায়ে (স্টেজ ফোর) পৌঁছে গিয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, বছর ষাটেকের সুবিমল রায়ের আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস। ফুসফুস থেকে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের নানা জায়গায়। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকছেন তিনি। মরফিন দিলে একটু সুস্থ। কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই যে কে সেই।
পঞ্চান্ন বছরের লীলা সাহা। তৃতীয় ধাপের (থার্ড স্টেজ) ক্যানসার নিয়ে ভর্তি কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে। খাদ্যনালীতে ক্যানসার। মরফিন ট্যাবলেট গিলে খাওয়া দূর অস্ত, গলা দিয়ে নলও ঢোকানো যাচ্ছে না। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনি। কাজ হচ্ছে না ইঞ্জেকশনেও। হাসপাতালের চিকিৎসক ছাড়াও ভয়াবহ সেই যন্ত্রণার অসহায় সাক্ষী তাঁর স্বামী ও মেয়ে।
শুধু সুবিমলবাবু বা লীলাদেবীই নন, অসংখ্য তৃতীয় বা চতুর্থ ধাপের ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রে যন্ত্রণা কমানোই একটি প্রধান সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রেই মরফিন ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন বা ব্যথা কমানোর প্যাচ দিয়েও ভয়াবহ যন্ত্রণা কমানো যায় না। পরিজনেরা অসহায় হয়ে দেখেন অসহ্য যন্ত্রণার সঙ্গে একটু একটু করে ঘনিয়ে আসছে মৃত্যু। ইদানীং চিকিৎসকদের একাংশ মনে করছেন, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হয়ে উঠতে পারে ‘ইন্ট্রাথিক্যাল পাম্প’ নামে ছোট্ট এই যন্ত্রটি। বিদেশে এটি বহুল ব্যবহৃত হলেও এ দেশে ইদানীং এর ব্যবহার শুরু হয়েছে।
কী এই ইন্ট্রাথিক্যাল পাম্প?
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সুষুম্নাকাণ্ড ও তার বাইরের খোলসের মধ্যবর্তী অংশটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ‘ইন্ট্রাথিক্যাল স্পেস’। পাঁজরের ঠিক নীচে একটি ছোট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পাম্পটি বসানো হয়। পাম্পের মধ্যে ভরা থাকে ওষুধ। পাম্প থেকে বেরনো একটি সরু নলের (ক্যাথিটার) সাহায্যে সুষুম্নাকাণ্ডের এই অংশে বেদনা-নাশক ওষুধ পাঠানো হয়। ওষুধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় বাইরে থেকেই। ওষুধ ফুরিয়ে গেলে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ফের তা ভর্তি করা যায়।
কী ভাবে কাজ করে যন্ত্রটি?
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শরীরে যে কোনও যন্ত্রণার অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌঁছয় স্নায়ুর মাধ্যমে। তাই যদি বিশেষ কোনও প্রক্রিয়ায় স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে বেদনার অনুভূতির চলাচলকে বন্ধ করা যায়, তা হলেই আর কোনও যন্ত্রণা হবে না। ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মরফিন নিলে কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই মরফিনের প্রভাব কমে যায়। তখন আবার শুরু হয় যন্ত্রণা। কিন্তু এই পাম্পটির সাহায্যে যে হেতু একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দিষ্ট মাত্রায় মরফিন দেওয়া চলতেই থাকে, তাই যন্ত্রণার ঝুঁকি প্রায় থাকে না বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। আবার কম পরিমাণ মরফিন দেওয়া হয় বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায় বলে চিকিৎসকদের দাবি। শুধু ক্যানসারই নয়, সেরিব্রাল পলসি বা ওই জাতীয় রোগের ক্ষেত্রেও ইন্ট্রাথিক্যাল পাম্প ব্যবহার করা যায় বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
যদিও এই মুহূর্তে এ দেশে যন্ত্রটির ব্যবহার নিয়ে কার্যত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে চিকিৎসক মহল। চিকিৎসকদের একাংশ যখন যন্ত্রটি ব্যবহার করার পক্ষপাতী, অন্য অংশ তখন এ দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যয়বহুল যন্ত্রটির উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পেন’-এর মুখ্য কার্যনির্বাহী সম্পাদক, চিকিৎসক গৌতম দাস বলেন, ‘‘এই যন্ত্রটি ব্যবহার করলে যন্ত্রণা মুক্তির সম্ভাবনা একশো শতাংশ।’’ আবার আর জি করের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় জানান, এই ধরনের যন্ত্রের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তার চেয়ে ‘ওরাল মরফিন’ অনেক বেশি কার্যকরী। তিনি বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে মরফিন দেওয়া হয়। আমাদের দেশে যন্ত্রণা উপশমের ক্ষেত্রে এ জাতীয় যন্ত্রের কোনও ভূমিকা নেই।’’ সুবীরবাবুর সঙ্গে একমত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর মতে, এই ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি যথেষ্ট সমাদৃত ও স্বীকৃত হলেও এটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই পদ্ধতি ব্যয়বহুল।
তবে ভিন্নমত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সোমনাথ সরকার। তঁর কথায়, ‘‘আমাদের দেশে যন্ত্রণা উপশমকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রত্যেকটি হাসপাতালে আলাদা করে ‘পেন ক্লিনিক’ থাকা উচিত। এক জন মানুষকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাই এ ধরনের যন্ত্র যত বেশি ব্যবহার হবে ততই মঙ্গল।’’