কাফের কাপে গরিমার সাত-রং। ছবি: সমাজমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত
শহরের শতাব্দীপ্রাচীন চা-ঘরের ধ্রুপদী রাম বলে সাতরঙা রামধনুর ছোঁয়া এই গরিমা মাসে। গড়িয়াহাট, ল্যান্সডাউনের কাফের কাপ থেকে আইসক্রিমেও মিশেছে রামধনু রং।
এ শহরের সমপ্রেমী লিভ-ইন জুটি অরিত্র কাঞ্জিলাল, সাত্যকি দাশগুপ্তদের কাছে এই রং বদল মোটেও সাময়িক বাহ্যিক বদল নয়। দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট-বড় কর্পোরেটের ‘প্রাইড মাস’ উদ্যাপনের মধ্যে একটা মন বদলের ছোঁয়াও তাঁরা দেখছেন। কয়েক মাসে পার্ক স্ট্রিটের একটি ‘পাবে’ বসেছিলেন অরিত্র, সাত্যকিরা। জনৈক পরিবেশনকারী এসে অরিত্রকে বলেন, “স্যর রবিবারের ব্রাঞ্চটায় ম্যাডামকে আনতে ভুলবেন না!” কে ম্যাডাম? পাল্টা প্রশ্নে ওই কর্মী বলেন, ‘স্ত্রী বা বান্ধবীর কথা বলছি!’ অরিত্র, সাত্যকিরা সে দিন বোঝান, তাঁরা দু’জনেই দম্পতি। এবং দম্পতি মানেই কোনও স্যর, ম্যাডামের গল্প নয়। পরে ইনস্টাগ্রামে বার্তা পাঠিয়ে অরিত্র ওই পাব কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব দেন, অতিথিদের লিঙ্গ পরিচয়ের বৈচিত্র্য নিয়ে তাঁরা সচেতনতা-শিবির বসাতে পারেন। চলতি গরিমা মাসেই তেমন সভার আয়োজন করেছেন ওই পাব কর্তৃপক্ষ। এক রূপান্তরকামী তরুণী অনুপ্রভা এসে কর্মচারীদের বোঝান— কারা রূপান্তরকামী, এবং তথাকথিত নারী, পুরুষের বাইরেও অতিথিদের নানা পরিচয় থাকতে পারে। অনেকেই মানছেন, ৩৭৭ অপরাধ তকমামুক্ত হওয়া বা ট্রান্স অধিকার আইন প্রকাশের পরে ছক-ভাঙা মেয়েপুরুষ (নন-বাইনারি) বা সমকামী, রূপান্তরকামীদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার চেষ্টা বাড়ছে।
জনসংযোগকর্মী তথা সমাজকর্মী রুকসানা কাপাডিয়া এবং তাঁর সঙ্গিনী সুনেহা সাহাও বিশ্বাস করেন, সমপ্রেমী বা ট্রান্স-বিদ্বেষ মুছে যায়নি! কিন্তু কলকাতা তাঁদের জন্য অনেকটাই নিরাপদ, সুরক্ষিত আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কয়েক জায়গায় ঠাঁই পেতে ঠোক্কর খেয়েছেন ঠিকই। আবার যখন পেয়েছেন, তখন সব কিছু জানিয়েই ফ্ল্যাট ভাড়া পেয়েছেন। অরিত্র, সাত্যকি বহুজাতিক কর্পোরেট কর্মী। অরিত্র বলছিলেন, “বেশির ভাগ কর্পোরেটই ডাইভার্সিটি, ইকুইটি, ইনক্লুসিভিটি নীতিতে খুবই গুরুত্ব দেয়। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মতো সমপ্রেম বিদ্বেষ বা ট্রান্স বিদ্বেষের অভিযোগেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।” রুকসানা বলছেন, “নারী দিবসে নানা ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দেখা গেলেও নারীবিদ্বেষ পুরোটা মুছে গিয়েছে বলতে পারি না! ঠিক তেমনই ট্রান্স বা সমপ্রেমীদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও রামধনু গরিমায় বিশ্বাসী এবং তাঁদের বন্ধুরা বৃহত্তর সমাজের কাছে মর্যাদা আদায় করেই ছেড়েছেন।”
তাই অ্যাপ-ক্যাবের লোগো বা ওটিটি-র সিনেমা তালিকা নয়, সালোঁ বা রেস্তরাঁতেও এ মাসে সমপ্রেমী, রূপান্তরকামীদের ডেকে উদ্যাপন চলছে। কিন্তু এ কি দু’দিনের খাতিরদারি? ২৫০টি কর্পোরেট সংস্থাকে নিয়ে গড়া ‘প্রাইড সার্কল’ মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, জামশেদপুরের তরুণ রামকৃষ্ণ সিংহ মানছেন না। বলছেন, “কর্পোরেটে বৈষম্য কাটাতে বছর তিনেক ধরেই এলজিবিটিকিউ জব ফেয়ার হচ্ছে। পাঁচতারা হোটেল, রেস্তরাঁ, আইটি সংস্থাও রূপান্তরকামীদের সুযোগ দিচ্ছে। সমপ্রেমীদের সামগ্রী কেনাকাটির পোর্টাল দারুণ জনপ্রিয়। প্রাইড মাসে এ সবের ছাপ পড়ছে।” অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কে যুগ্ম অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন সমপ্রেমী বা ট্রান্স জুটিরা। তাঁদের এক কর্তা বলছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিধি মানলে অন্য ব্যাঙ্কগুলিতেও এই অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। কলকাতায় বসে সায়ান বলে একটি মঞ্চে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশের যৌন সংখ্যালঘুদেরও একজোট করতে সক্রিয় বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “জামশেদপুর, চন্দননগর আসানসোল থেকে কোকরাঝোড়ও প্রাইড উদ্যাপনে মাতছে। বড় শহর এবং কর্পোরেটের সমর্থন অনেককেই অধিকার নিয়ে সরব হতে শেখাচ্ছে।”