টেলিভিশন কিংবা অনলাইনে কুকিং ক্লাসে বহু রান্নাতেই অলিভ অয়েলের ব্যবহার দেখতে পাই আমরা। তবে বাড়ির রান্নায় বেশির ভাগ সময়ে ব্যবহার হয় সাদা তেল। কখনও সয়াবিন অয়েল, কখনও সানফ্লাওয়ার অয়েল কিংবা রাইস ব্র্যান অয়েল। অনেকের বাড়িতে আবার অলিভ অয়েলের একটি শিশি রাখা থাকে বটে, তবে তা ব্যবহার করা হয় মাঝেমধ্যে, বিশেষ কোনও পদ রান্নায় বা স্যালাডে। অন্য তেলের চেয়ে দামের তফাত বেশি হওয়ায় সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের হেঁশেলে অলিভ অয়েলের ব্যবহার সীমিত হলেও এর গুণাগুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে জেনে রাখা প্রয়োজন।
অলিভ অয়েলের ব্যবহার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলি থেকে। গ্রিস, স্পেন, ইটালি, মরক্কোর মতো দেশগুলি এখনও অলিভ অয়েলের উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম সারিতে। ইটালিয়ান বা স্প্যানিশ কুইজ়িন বিশ্বখ্যাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই অলিভ অয়েলের ব্যবহারও পৌঁছে গিয়েছে বিভিন্ন দেশের রান্নাঘরে। মূলত রান্নায় কোনও ভাজাভুজি বা ড্রেসিংয়ের উপকরণ হিসেবেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এই ভেজিটেবল অয়েল। তবে রূপচর্চা ও প্রসাধনী সামগ্রী কিংবা ওষুধ তৈরিতেও এর ব্যবহার রয়েছে।
গুণবিচার
অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসে ভরপুর ও মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ এই ভেজিটেবল অয়েলের গুণ বড় একটা কম নয়। বিশেষ করে রক্তে এলডিএল অর্থাৎ ‘ব্যাড কোলেস্টেরল’-এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, কার্ডিয়োভাসকুলার সিস্টেমকে ভাল রাখার দাওয়াই হিসেবে প্রত্যেক দিন দুই টেবিল চামচ (২৩ গ্রাম) করে অলিভ অয়েলের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এক টেবিল চামচ (১৩.৫ গ্রাম) অলিভ অয়েলে থাকে ১১৯ ক্যালরি, ১৩.৫ গ্রাম ফ্যাট, যার মধ্যে ২ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট, এ ছাড়া ভিটামিন ই এবং কে। থাকে ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিডও। সেল ড্যামেজ রুখতে, উচ্চরক্তচাপ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডায়েটে কিংবা সার্বিক আয়ুবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অলিভ অয়েলের ব্যবহার ও উপযোগিতা উল্লেখযোগ্য। লো-ফ্যাট ডায়েট মেনটেন করতে হয় যাঁদের, তাঁদের রান্না অলিভ অয়েলে করা হয়ে থাকে সাধারণত।
রান্নায় আলাদা মাত্রা
পাস্তা, স্যালাড ড্রেসিং, সস কিংবা মাছ-মাংসের ম্যারিনেড হিসেবে অলিভ অয়েল ব্যবহার হয়ে থাকে প্রায়শই। অনেকের ধারণা, অলিভ অয়েলের আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকায় উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলে তার পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে না। এই ধারণার ঠিকভুল বিচার করার আগে দেখতে হবে, রান্নায় কোন ধরনের অলিভ অয়েল ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, ভার্জিন অয়েল এবং রিফাইনড অয়েল— তেল নিষ্কাশন ও তার পরিশোধনের উপরে ভিত্তি করে আলাদা মাত্রার অলিভ অয়েল তৈরি হয়। প্রত্যেকটির গুণাগুণ ও স্মোক পয়েন্ট (যে তাপমাত্রায় ফ্যাট ভেঙে যায় ও স্মোক তৈরি হয়) আলাদা।
এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল হল সরাসরি ‘কোল্ড প্রেসিং’ পদ্ধতিতে অলিভ থেকে নিষ্কাশিত তেল, যাতে কোনও কেমিক্যাল মেশানো হয় না, যা এই তেলের সবচেয়ে শুদ্ধ রূপ। এর গুণাগুণও সর্বোচ্চ। এই তেল উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলে এর গুণ বজায় থাকে না। তাই মূলত ড্রেসিং বা অল্প আঁচে রান্নার জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল।
অন্য দিকে, রিফাইনড অলিভ অয়েল আবার বেশি তাপমাত্রায় রান্না করা যেতে পারে, কারণ তার স্মোক পয়েন্টও বেশি। এক্সট্রা ভার্জিন অয়েলের আরও প্রসেসড ও রিফাইনড ভার্সনে গুণাগুণ ও মানও বদলে যাবে। তবে ভারতীয় রান্নার পদ্ধতি ও ধাঁচের সঙ্গে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল খুব বেশি মেলে না। মূলত কাঁচা বা ঠান্ডা খাবার, স্যালাডের ড্রেসিং বা হালকা সতে করে নেওয়ার পক্ষে এই তেলের ব্যবহার আদর্শ। আবার ডিপ ফ্রাই করতে গেলে এরই রিফাইনড ভার্সন ব্যবহার করা যেতে পারে।
তেলে তাজা
রূপচর্চা ও ত্বকের যত্নে অলিভ অয়েলের ব্যবহারও বহু প্রাচীন। ত্বক আর্দ্র রাখা, অ্যাকনের সমস্যা দূর করায় কার্যকর উপাদান হিসেবে অলিভ অয়েলের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। এ ছাড়া বিভিন্ন হেয়ার প্যাক ও স্কিন কেয়ার প্যাকেও অলিভ অয়েল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আন্ডার আই ময়শ্চারাইজ়ার হিসেবে, মেকআপ রিমুভার হিসেবে এবং চুলের কন্ডিশনার হিসেবেও অলিভ অয়েলের কার্যকারিতা রয়েছে।
শুধু তাই নয়, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি হিসেবে সুপরিচিত অলিভ অয়েল, যার অ্যান্টি-এজিং এবং অ্যান্টি-ট্যান এজেন্ট বিভিন্ন স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বলিরেখা দূর করতে, ক্ষত সারাতেও অলিভ অয়েল উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। শীতকালে রুক্ষ ত্বকের জেল্লা ফেরাতে অলিভ অয়েলের জুড়ি নেই।
কাজেই এক শিশি অলিভ অয়েল জায়গা করে নিতেই পারে আপনার হেঁশেলে। আর রান্নাঘরে হোক কিংবা ড্রেসিং টেবলে, ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানলে এই তেলই হয়ে উঠবে আপনার বন্ধু।