সাবেক বাঙালি খাবারেই নতুনের মোড়ক, পরিবেশনেও মুন্সিয়ানা রন্ধনশিল্পীদের। নিজস্ব চিত্র।
ইলিশ আর শিমের দানার ভর্তা খেয়েছেন কখনও? শুক্তো থেকে রাঙা আলু, আলু, সজনে ডাঁটা বাদ দিয়ে যদি শুধু ঝোলটাই পরিবেশন করা হয়? তাতে ভাসবে কয়েকটি নিরীহ উচ্ছে। আলু খাওয়া মানা হলেও চিন্তা নেই। ঝোলটা চুমুক দিয়ে খেলেই উপকার। আবার ধরুন, কুমড়ো ফুলের পেটে চিংড়ি না ভরে যদি ছানা ঠেসে দেওয়া হয়, তা হলে কেমন হবে?
সাবেক জিনিসে মন ফেলে রেখে লাভ নেই । কিন্তু যদি সাবেককেই নতুন মোড়কে সাজিয়ে গুছিয়ে সামনে ধরা হয়, তা হলে সেটিই লোভনীয় হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। বাঙালি হেঁশেলের সাবেক কিছু পদকে স্রেফ মশলা আর উপকরণের সামান্য হেরফেরে আর পরিবেশনের দক্ষতায় যে অসামান্য করে তোলা যায়, তাই দেশ-বিদেশের তিন রন্ধনশিল্পী— নয়না আফরোজ, পিনাকি রায় ও সুশান্ত সেনগুপ্ত। সল্ট লেকের ৬, বালিগঞ্জ প্লেসে ভিন্ন জায়গা থেকে আগত তিন রন্ধনশিল্পীর নিজস্ব ভাবনার কিছু পদ পরিবেশন করা হল, যার সব ক’টিতে ছিল অভিনবত্ব। এককথায় বললে, ফিউশন-বাঙালিয়ানার নতুন নজির তৈরি করলেন রন্ধনশিল্পীরা।
কুমড়ো ফুলের বড়া, ডালপুড়ি, শুক্তোর ব্রথ। নিজস্ব চিত্র।
ঠিক ফিউশন খাবারের উৎসব হচ্ছে, তা বলা যায় না। বরং বলা ভাল, স্বাদবদলের জন্য বাঙালি খাবারকেই নতুন মোড়ক দেওয়া হয়েছে। থালার চারপাশে বাটি সাজিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন খাওয়ার রেওয়াজ তো অনেক হল। এ বার যদি ভাত, পাঁচ রকম ভাজা, ডাল, শুক্তো মাছের পদগুলিকেই একটু এ দিক-ও দিক করে নতুন গল্প তৈরি করা যায়, তাতে ক্ষতি কী! সে চেষ্টাই করলেন রন্ধনশিল্পীরা। ধরুন, এত দিন ভাজা বড়ি দেওয়া লাউঘণ্টের সঙ্গে ভাত মেখে সাপটে খেয়েছেন। এ বার আপনাকে পোর্সেলিনের থালায় বাটি চাপা গোলপানা ভাতের উপরে তেমনই গোল করে লাউ-বড়ি সাজিয়ে তার উপরে কুড়মুড়ে চিংড়ি ভাজাটি সাজিয়ে দেওয়া হল। হলফ করে বলা যায়, এমন পরিবেশনের পদ্ধতি দেখে জিভে জল আসবেই। রান্নাটি কিন্তু সেই পুরনো লাউ-চিংড়িই। কেবল তা রাঁধার প্রণালী ও পরিবেশনে বদল এনে আরও আকর্ষক করে তোলা হয়েছে।
হেতুমারি চালের ভাতের উপরে তিন রকম ভর্তা। নিজস্ব চিত্র।
লাউপাতার মোড়কে বাগদা ভাপা। নিজস্ব চিত্র।
সব খাবারেরই নিজস্ব গল্প থাকে। নিজস্ব স্বাদ, গন্ধ, পরিচয়ও থাকে। রন্ধনপ্রণালীর হেরফেরে ও নতুন মশলার সহযোগে সে নিজস্বতার মোড় বদলে যায়। নতুন গল্প তৈরি হয়। নতুন-পুরনোর এই মেলবন্ধনটাই হল ‘ফিউশন’। তিলোত্তমা কলকাতা সেই কবে থেকেই রসনার এই মিলমিশকে আপন করে নিয়েছে। তবে বাঙালি খাবারে ফিউশন কমই হয়েছে। সে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নয়না, পিনাকি ও সুশান্তের মতো অভিজ্ঞ রন্ধনশিল্পীরা।
সরু চাকলি দিয়ে মটন ভুনার স্বাদ অতুলনীয়। নিজস্ব চিত্র।
নয়না বললেন, “মাছ রেঁধে খাওয়াতে গেলে মনে রাখতে হবে, কোন মাছ সেই সময়টাতে পাওয়া যাচ্ছে। এখন পারসে, পাবদার সময়। পারসে আর চিতল মাছ দিয়ে গতানুগতিক রন্ধনপ্রণালীর বাইরে গিয়ে মেনু সাজানো হয়েছে। বাঙালির অতি সাধারণ কিছু রান্নাতেও আনা হয়েছে অভিনবত্ব, যাতে সব বয়সের মানুষের ভাল লাগে এবং স্বাদবদলও হয়।” যেমন, ভর্তার কথাতেই আসা যাক। নানা রকম ভর্তা রান্নায় পারদর্শী নয়না। শিমের দানা দিয়ে ইলিশের ভর্তা, মাসকলাই বড়ি দেওয়া চিংড়ির ভর্তা আর নারকেল সর্ষের ভর্তার সঙ্গে হেতুমারি চালের লাল ভাত ও বাজরার রুটি মিশিয়ে নতুন চেহারা দেওয়া হয়েছে। আবার ধরা যাক কুমড়ো ফুল। বাঙালির প্রথম পাতে কুমড়ো ফুলের বড়া খুবই লোভনীয় একটি পদ। রন্ধনশিল্পীরা কেই কুমড়ো ফুলের পেটে ছানা, কড়াইশুঁটি ও আম কাসুন্দি ভরে তার চেহারাই বদলে দিয়েছেন। বাগদা চিংড়ি ভাপাতেও আছে অভিনবত্ব। বাগদা চিংড়ি সর্ষে বাটায় ভাপিয়ে তার সঙ্গে ডাবের শাঁস মিশিয়ে তা লাউপাতার মোড়কে ভরে, দেখতে হয়েছে খাসা। নয়না তাতে যোগ করেছেন সামান্য রসুনের রস। আর তাতেই স্বাদটা আরও খোলতাই হয়েছে।
পারসে-চিতলের যুগবন্দি। নিজস্ব চিত্র।
রন্ধনশিল্পী সুশান্তের কথায়, “দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাবেকিয়ানার সঙ্গে খানিকটা ফিউশন ‘টাচ্’ও যুক্ত হয়েছে। গ্রাহকেরা সাবেকিয়ানার মধ্যেও নতুন কিছু খুঁজছেন। একঘেয়ে স্বাদে আর রুচি নেই। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের ধরনেও বদল আসছে।” আসলে গাঁটের কড়ি খসিয়ে নামী রেস্তরাঁয় গিয়ে একই স্বাদের খাবার আর কেউ খেতে চাইছেন না। তাই দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের প্রান্তিক খাবার ও মশলা সহযোগে চেনা খাবারের স্বাদেই বদল আনার চেষ্টা হচ্ছে। খাবারের মেনুটা পুরোটাই নির্ভর করে গ্রাহকের চাহিদা ও বাজেটের উপর। ভোক্তার স্বাদবদল আর মেনুর বদল তাই অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে।
ভাপা দই। নিজস্ব চিত্র।
তাই রুটি-কষা মাংস বা লুচির সঙ্গে কব্জি ডুবিয়ে কচি পাঁঠার বদলে খাসির কালা ভুনার সঙ্গে সরুচাকলি খেতে পছন্দ করছেন অনেকেই। চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি সরু চাকলির সঙ্গে ছোট ছোট টুকরো করা মটন ভুনা মাখিয়ে খেতে খারাপ লাগবে না। মাছে-ভাতে বাঙালি। ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল মেখে খেতেই অভ্যস্ত। রন্ধনশিল্পীরা এখানেও বদল এনেছেন। পারসের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন চিতলকে। হলুদ ভাতের উপরে সর্ষে-পারসেকে শুইয়ে দিয়েছেন বহাল তবিয়তে। ভাতের নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে চিতলের পেটি। মাছের পোলাওয়েরই নতুন রূপ পারসে-চিতলের যুগলবন্দি।
ছানার জিলিপির দোসর ছানার পায়েস। নিজস্ব চিত্র।
মিষ্টি ছাড়া তো বাঙালি ভোজের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না। শেষ পাতে আর কিছু না হোক, মিষ্টি দই চাই-ই চাই। সেখানেও রয়েছে পরিবেশনের মুন্সিয়ানা। ভাপা দইয়ের উপরে তিন স্তরে পেস্তা বাটার পুরু পরত, তার উপরে ড্রাই ফ্রুট্সের আভিজাত্য আর শেষে ক্যারামেলের চমক। দইও হল, আবার তাতে ক্যারামেল কাস্টার্ডের ছোঁয়াও লাগল। ছানার জিলিপির দোসর হয়েছে ছানার পায়েস। বাঙালির ভাজা পিঠেরই সহোদর নারকেলের পেরাকি। নারকেলের পুরে ভরে দেওয়া হয়েছে আদা কুচি।
স্বাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যও কিন্তু জড়িত। স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে স্বাদবদলের মানে হয় না। তাই ভূরিভোজের পরে নরম পানীয় বা জলজিরার বদলে রন্ধনশিল্পীরা দিব্যি সাজিয়ে দিয়েছেন পাঁচ ফোড়নের ‘স্পার্কলিং’ সিরাপ। খেলেই হজম হবে অবধারিত। মুখশুদ্ধিতে পান বা পানমশলা নয়। ডার্ক চকোলেট দিয়ে তৈরি ছোট্ট ফুলের ভিতরে পুরে দিয়েছেন গুলকন্দ। মিষ্টি খেয়ে যতটা ক্যালোরি বাড়বে, তাকে দমিয়ে দেবে ডার্ক চকোলেট, আর গুলকন্দে মুখশুদ্ধিও দিব্যি হবে।