ক্লাস ওয়ানের ঋতুরাজ বিকেলে খেলা ছেড়ে মজে থাকে কার্টুনে। সোফায় হেলান দিয়ে ফোনে কার্টুন দেখা তার চাই-ই চাই। ফোন না দিলেই সে কেঁদে বাড়ি মাথায় করে।
ক্লাস নাইনের অমৃতাও রাত জেগে সিরিজ়ের পর সিরিজ় দেখে চলেছে। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়লেই অন্ধকার ঘরে চোখের কাছে ক্রমশ ফোন চলে আসে তার...
লকডাউন পরবর্তী নিউ নর্মাল জীবনের সঙ্গে সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত। আপাতত পড়াশোনার জন্য অনলাইন ক্লাসই ভরসা! কিন্তু অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ডিজিটাল জীবনের প্রতি অত্যধিক আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে না তো আপনার সন্তান? নজর রাখুন সে দিকে...
কারণ খুঁজতে হবে
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, ‘‘ডিজিটালের নেশা কেন হচ্ছে? আগে কারণ খুঁজে বার করতে হবে। অনেক সময়ে দেখা যায়, বাড়িতে মা-বাবার ঝগড়া বা অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে সন্তান ফোন নিয়ে বসে থাকে। কিছু বাড়িতে আড্ডার পরিবেশ থাকে না। তখন তারা মনের খোরাক খুঁজে পায় ভার্চুয়াল জগতেই।’’ অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত অনেক শিশুই হয়তো ফোন, ল্যাপটপ ধরত না। কিন্তু এখন তারা এই জিনিসটা হাতে নিচ্ছে, ব্যবহার শিখছে। ফলে তার প্রতি আকর্ষণও বাড়ছে।
কী কী করবেন
• ভার্চুয়াল ও বাস্তব জীবন ব্যালান্স করতে হবে। পড়াশোনার জন্য, শেখার জন্য ডিজিটাল অবশ্যই একটি মাধ্যম। কিন্তু সব সময়ের সঙ্গী নয়। এই রেখা টানতে হবে বাবা-মাকেই। রুটিন করে সন্তানকে ঘর গোছানোর কাজ, গাছে জল দেওয়া, গাছের পরিচর্যার কাজ শেখানো জরুরি। সন্তানের আগ্রহ থাকলে রান্নার কাজেও তার সাহায্য নিতে পারেন।
• রাস্তায় বেরোনোয় বিধিনিষেধ থাকলেও বাড়ির মধ্যেই খোলামেলা জায়গায় ছেড়ে দিন ওকে। সেটা ছাদ, জানালার ধার বা বারান্দা হতে পারে। সেখানে ও নিজের মনে লিখুক, আঁকুক বা চুপ করে বসে আকাশ দেখুক। ওকে ওর মতো থাকতে দিন সেখানে। একটা দূরবিনও তুলে দিতে পারেন হাতে। তা দিয়ে নানা রকম পাখি দেখতে পাবে। প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠবে।
• সন্তান ছোট হলে ফোন তার হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখা জরুরি। সেই সময়ে তার হাতে তুলে দিন মজার বই, খেলনা, রং... সে কোনও কার্টুন ক্যারেক্টারের ভক্ত হলে সেই কার্টুন ফোনে না চালিয়ে তার উপরে লেখা একটা বই কিনে দিতে পারেন। সেই বইটিই হোক সন্তানের সঙ্গী।
• মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ডিজিটালের নেশাটা বিহেভিয়োরাল। ব্যবহার পাল্টাতে পারলে নেশা কাটবে। খেলাধুলোর মতো পরিসর না থাকলে ক্যারম, লুডো, দাবা ইত্যাদি বোর্ড গেম কিনে দিতে পারেন।’’ সন্তানের সঙ্গে নিজেরাও খেলতে শুরু করুন।
• সন্তান বড় হলে তার উপরে জোর করা চলবে না। বন্ধুর মতো মেশার চেষ্টা করুন। ডিজিটাল লাইফের বাইরেও যে একটা সুন্দর জীবন আছে, তার স্বাদ-গন্ধ-বর্ণের সঙ্গে তার পরিচয় করান। হতে পারে, আপনার সন্তানও এই নেশার হাত থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। সেই হাত বাড়িয়ে দিন।
• অনেকেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে, খেতে খেতে, এমনকি স্নানঘরেও ফোন ঘাঁটেন। এই অভ্যেস পাল্টানো জরুরি। বাড়ির মধ্যেই মোবাইল, ল্যাপটপ রাখার জায়গা অর্থাৎ ডিজিটাল স্পেস তৈরি করুন। ধরুন, একটা ঘরে বা টেবিলে সে সব রাখলেন। যে যখন ডিজিটাল কাজ করবে, সেই ঘরে বা সেই টেবিলে করবে। তা হলে সেই জায়গাটা ছেড়ে সে যখন বেরোবে, মানসিক ভাবে ভার্চুয়াল জগৎ ছেড়ে বাস্তবের জীবনে পা রাখতে পারবে। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর।
• অ্যাকোয়াকিয়াম বা ফিশ বোলে নতুন মাছ এনে ছেড়ে দিতে পারেন। বাড়ির খুদেটি সময় কাটানোর সঙ্গীও পেয়ে যাবে। আর মাছের যত্ন নিতে, জল পরিষ্কার করতে অনেকটা সময় কেটে যাবে।
কী কী করবেন না
• পায়েল ঘোষ বললেন, ‘‘অনেক সময়ে মা-বাবারাও ডিজিটাল-নির্ভর হয়ে পড়েন। সন্তানও যাতে বিরক্ত না করে, তার হাতেও মোবাইল ধরিয়ে দেন। এটি করা চলবে না।’’ মনে রাখতে হবে, ডিজিটাল ডিটক্স পুরো পরিবারকে একসঙ্গেই করতে হবে। যেহেতু এখন অনেকটা সময় সকলে একই ছাদের তলায় কাটাচ্ছেন, তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। তাই বলে কি মা-বাবা পছন্দের সিনেমা-সিরিজ় দেখবেন না? অবশ্যই দেখবেন। সেই সময়টা বুদ্ধি করে বার করে নিতে হবে, সন্তানের আড়ালে।
• ছুটির দিনে বা অবসরে সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই একটা ভাল ছবি চালিয়ে একসঙ্গে দেখুন। এতে সে-ও আনন্দ পাবে, আপনার উপরে ভরসা করতেও শিখবে। পরে আপনি যদি তাকে বারণ করেন, সে শুনবে।
• প্রথমেই সন্তানকে বকাবকি করে কাজটা বন্ধ করতে বলবেন না। তাতে কাজ কম হবে। বরং বাড়িতে গল্প, আড্ডার পরিবেশ তৈরি করুন। তাতে সন্তানকেও ইনভলভ করুন। ওর ছোটবেলার গল্প বলুন। দেখবেন সন্তানও আগ্রহী হয়ে ফোন ছেড়ে সেই আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।
যে কোনও অভ্যেসই তৈরি করার সময়ে প্রথম প্রথম কষ্ট হয়। কিন্তু ডিজিটাল ও বাস্তব জীবন ব্যালান্স করতে পারলে তবেই তা স্বাস্থ্যকর হবে। আর সন্তানের এই অভ্যেস গড়ে তোলার গুরুভার কিন্তু মা-বাবাকেই নিতে হবে।
মডেল: ঐশ্বর্য সেন, রোমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: শান্তনু পাল