চাপিয়ে দেওয়া এই ঘরবন্দি দশা ছাড়া এ মারি ঠেকানোর অন্য কোনও উপায় নেই। ছবি:
কোভিড-১৯ নিয়ে চিন্তায় ঘুম নেই আমাদের। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে রোজ। নাস্তানাবুদ হচ্ছি লকডাউন নিয়ে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে। প্রচন্ড মানসিক চাপ। কিন্তু তারই মধ্যে যখন দেখি উন্নত বিশ্বের চেয়ে আমরা এখনও ভাল আছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্ণধারও শিলমোহর লাগান তাতে। বলেন, “ভারত যে পথে চলেছে, সেটাই পথ, সে পথেই আসবে সমাধান,” নতুন করে আশায় বুক বাঁধি। অবাকও লাগে, না আছে ওষুধ, না প্রতিষেধক, নিরন্ন-রুগ্ণ মানুষের মেলা চারদিকে, তা-ও এ পথেই সমাধান আসবে!
ইতিহাস অন্তত তাই বলে। ভেবে দেখুন মারাত্মক স্প্যানিশ ফ্লুয়ের কথা, ১৯১৮-’২০, তার মধ্যেই সারা পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে গ্রাস করে নিয়েছিল সে, মারা গিয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষ, কম করে ৫-১০ কোটি। তার মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদুও ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যান এইচ১এন১ ভাইরাসের এই মারাত্মক প্রজাতির আক্রমণে।
ভারতে? সরকারি হিসেবে ১.৭-১.৮ কোটি। বেসরকারি হিসেবে? বিখ্যাত হিন্দি লেখক ও কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠীর লেখা থেকে জানা যায়, সে সময় রাজপথের রাস্তায়, অলিগলিতে পড়ে থাকত মৃতদেহের স্তূপ, গঙ্গায় ভেসে যেত ফুলে ওঠা মৃতদেহ। কে কার সৎকার করবেন, কে কাকে কবর দেবেন, সবার ঘরেই তো রোগ! মহিলারা বেশি আক্রান্ত হতে থাকেন। স্বাভাবিক। অপুষ্টি তাঁদেরই বেশি। বদ্ধ, অস্বাস্থ্যকর ঘরে বসবাস তাঁদেরই বেশি। তার উপর তাঁদের হাতেই ছিল রোগীর সুশ্রুষার ভার। ফলে বাড়ির পুরুষটি যদি বা সুস্থ হয়েছেন, মহিলারা মারা গিয়েছেন নির্বিচারে। সঙ্গে অজ্ঞাতকারণে কমবয়সিরাও। ভাগ্যের ফেরে এই সময়েই শুরু হল ভয়াবহ খরা। গ্রাম থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ দলে দলে আসতে লাগলেন শহরে। পরিণতি? বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদেশি সরকার সমস্যা সমাধানে কোনও চেষ্টাই করলেন না বলতে গেলে। অসহায় মানুষগুলিকে মরতে দিয়ে তাঁরা পাহাড়ে গেলেন ছুটি কাটাতে। ডাক্তারের অভাব ছিল ভীষণমাত্রায়। তার উপর দেশীয় মানুষ জাত খোয়ানোর ভয়ে সেটুকু সুযোগও নেননি প্রায়। দেশীয় জড়িবুটি, ভেষজ, হোমিওপ্যাথির গুলিই ছিল তাঁদের ভরসাস্থল। তবু তার মাঝেও কিছু মানুষ সুস্থ হতে থাকলেন। এবং একটা সময়ের পর সংক্রমণের হার কমতে শুরু করল।
আরও পড়ুন: করোনার জেরে মিলছে না শিশুর অন্য রোগের ভ্যাকসিন! কী বিপদ ধাওয়া করছে এর পর?
ঊনবিংশ শতকে কলকাতায় চলছে প্লেগ রোগীর চিকিৎসা।
কী ভাবে?
‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের গণ্যমান্য মানুষেরা এগিয়ে আসেন এ সময়। গঠিত হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা কমিটি। এগিয়ে আসে বহু এনজিও। তাঁরা এক দিকে যেমন ওষুধ, ডাক্তার, খাবার ও মৃতদেহ সরানোর ব্যবস্থা করেন, চালু করেন কিছু অনুশাসনও, যেমন—
• সব রকম জমায়েতে যেতে বারণ করা হয়।
• দিন-রাতের অধিকাংশ সময় ঘরে থাকতে বলা হয়।
• খেতে বলা হয় পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ জল।
• বদ্ধ ঘরে না ঘুমিয়ে খোলা জায়গায় ঘুমোতে বলা হয়।
• বলা হয় সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে।
শরীরচর্চা ও উদ্বেগ কম রাখার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হয় জনে জনে। চালানো হয় নজরদারি। উদ্বেগ কমেও আসে। কারণ মানুষ বোঝেন এই বিপদে তাঁদের পাশে থাকার মতো মানুষ আছেন।
এর পাশাপাশি, দীর্ঘ দিন রোগের সঙ্গে সহাবস্থান করার ফলে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে মানুষের। সবে মিলে শেষরক্ষা হয় কোনওমতে।
আরও পড়ুন: স্যানিটাইজার মিলছে না? হাত ধুতে এর চেয়েও ভাল বিকল্প কী?
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে এ রকম আরও কত কী-ই যে হয় তার আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বিউবোনিক প্লেগ। জানা যায়, ইঁদুর থেকে মাছির মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মিশরে শুরু হয় তার দাপট। তার পর এক শষ্যবাহী জাহাজে চড়ে বাহক মারফত সে পৌঁছে যায় ইস্তাম্বুলে। সেখান থেকে সারা ইউরোপে। কেন, কী হচ্ছে তা বুঝতে বুঝতে শুরু হয়ে যায় মৃত্যুমিছিল। দিনে প্রায় ৫০০০ মানুষ মারা পড়তে থাকেন। ইউরোপের জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়ে সে বিদায় নেয়। মারা যান প্রায় ১০ কোটি মানুষ।
৮০০ বছর পর সে আবার ফেরে। সিসিলির মেসিনা বন্দরে নাবিকভর্তি জাহাজে সওয়ার হয়ে। কয়েক বছরের মধ্যে ইউরোপের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ, মতভেদে অর্ধেক মানুষ স্রেফ নিঃশেষ হয়ে যান। এই দুর্যেগের সময় ভেনিসে এক অভিনব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জাহাজ বন্দরের কাছাকাছি এলেই তাকে আটকে দেওয়া শুরু হয়। সমুদ্রে নোঙর ফেলে প্রথমে ৩০ কি ৪০ দিন কাটিয়ে, যখন নিশ্চিত হয় যে যাত্রী ও নাবিকদের কারও শরীরে আর জীবাণু নেই, হয় কারও সংক্রমণ হয়নি, নয়তো রোগে ভুগে সুস্থ হয়েছেন বা মারা গিয়েছেন, তখন বন্দরে ঢোকার ও শহরে পা রাখার অনুমতি মেলে।
এখান থেকেই কোয়রান্টিন শব্দটি এসেছে। লাতিন ভাষায় ৪০-কে বলে ‘কোয়রিন্তা’। আর এ ভাবে একাকী প্রায় বন্দি হয়ে থাকার নাম কোয়রান্টিনে থাকা। এই পদ্ধতিতে রোগের ছড়িয়ে পড়া যে ঠেকানো যায়, বহু পরীক্ষায় তা প্রমাণিত।
আমরাও এখন লকডাউনে আছি। কোয়রান্টিনে। ঠিক ভাবে প্রয়োগ করা গেলে এতে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা কমবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু রোগ সারবে কি?
আরও পড়ুন: মোবাইলেও ঘাপটি মেরে থাকে করোনাভাইরাস, কী ভাবে ব্যবহার করলে দূরে থাকবে অসুখ?
লকডাউনে বাইরে বেরলে জবাবদিহি করতে হচ্ছে পুলিশের কাছে।
একটু ভাবুন, যে সময়ে ভাইরাস মারার ওষুধ তো দূরস্থান, অ্যান্টিবায়োটিক পর্যন্ত ছিল না, ভেন্টিলেটর তো দূরস্থান, গুরুতর রোগীর চিকিৎসার অন্য সাধারণ সরঞ্জামও কিছু ছিল না, সে সময়ে এই ক’টি নিয়ম মেনে কিছু মানুষ তো প্রাণে বেঁচেছেন, যার মধ্যে মহাত্মা গাঁধীও আছেন, বহু মানুষের রোগ ঠেকানো গিয়েছে। তা হলে আজকের এই উন্নত প্রযুক্তির মাঝে থেকে, যেখানে সরাসরি ভাইরাস মারার ওষুধ এখনও না এলেও, ভাইরাসের প্রভাবে যা যা ক্ষতি হয় শরীরে, তাকে সামলানোর আয়ূধ আছে পর্যাপ্ত, দূরে থেকেও আমরা একে অন্যের পাশে আছি, সরকার অভিভাবকের মতো আছে মাথার উপরে, “আর সবচেয়ে বড় কথা উপরের অসুখ দু’টির তুলনায় এ রোগ অত মারাত্মক নয়, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ সংক্রামিত হওয়ার পর নিজে নিজেই সুস্থ হয়ে যান, জানতেই পারেন না রোগ হয়েছিল বলে, ২০ শতাংশের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, তার মধ্যেও প্রায় ১৫-১৬ জন সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যান, বাকিদের জটিলতা হলেও তা সামলানো যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, মারা যান ১-৩ শতাংশ মানুষ, বেশির ভাগই বয়ষ্ক ও অন্য কারণে গুরুতর অসুস্থ, তা হলে আমরা একে হারিয়ে জয়ী হব না কেন?” বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী।
কাজেই আসুন, অযথা ভীত না হয়ে, অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা নিয়ম মেনে চলা অভ্যাস করি। ঘরে থাকি। প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই ও ভরসা রাখি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)