সঞ্চারী ও তীর্থর বছর তিনেকের বন্ধুত্ব, সঞ্চারীর ভাষায়, ‘তীর্থ তার বেস্ট ফ্রেন্ড’। জীবনে যা যা ঘটে সমস্ত কিছু তীর্থর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া তার চাই-ই চাই! কিন্তু তীর্থ যেন কেমন, নিজের কিছুই জানাতে চায় না। কখনও কখনও মেসেজের উত্তরও দেয় না। সঞ্চারী সেই নিয়ে অনুযোগ করলে, চাঁচাছোলা ভাষায় জানিয়ে দেয়, ‘আমার যখন ফাঁকা সময় থাকবে, তখন উত্তর দেব।’ এক সময়ে রাগ হলেও এখন খুব ক্লান্ত লাগে সঞ্চারীর, নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়।
সঞ্চারীর এই অনুভূতিকে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যিকরা একটি বিশেষ নামে ডেকে এসেছেন, সেটি হল ‘অভিমান’। হ্যাঁ, অভিমান করেছে শুনতে খুব মিষ্টি লাগে। বাঙালির কল্পনায় আলাদা মাত্রা রয়েছে এই অনুভূতির, কিন্তু আদতে এর শিকড় বেশ গভীরে।
অভিমানের সংজ্ঞা কী?
কথায় বলে, রাগের চেয়ে অভিমানের তীব্রতা বেশি। আসলে অভিমান তার উপরেই হয়, যার প্রতি মানুষ নির্ভর করে। নির্ভরতা জন্ম দেয় কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতির। আর এই সূক্ষ্ম অনুভূতিতেই যখন আঘাত লাগে তখন যে মৃদু মানসিক কষ্টের সূচনা হয়, তাকেই বলা চলে অভিমান।
এখন সেই আঘাত দিনের পর দিন ধরে তৈরি হওয়া কোনও আশা পূরণ না হলে যেমন হয়, তেমনই উল্টো দিকের মানুষটি যদি অপ্রত্যাশিত কোনও আঘাত করে থাকে, তা হলেও হয়। দুটো অভিমানের প্রকাশ আলাদা হলেও ভিত্তি কিন্তু একই। সঞ্চারীর অভিমানকে যেমন সহজেই প্রথমটির আলোয় দেখা যায়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মানসিক উপসর্গের অভিধানে অভিমানের সমার্থক শব্দ খুঁজে পাওয়া না গেলেও এটি আসলে মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ আচরণ বা বিহেভিয়ার।’’
আসলে, মানুষের মস্তিষ্ক একটি সার্কিট। এই সার্কিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল লিম্বিক সিস্টেম। এটি শরীরে আবেগ ও স্মৃতিজনিত হরমোনের পরিবর্তনগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। এই সিস্টেমের অ্যামিগডালা সহ আনুষঙ্গিক কিছু অঞ্চলেই লুকিয়ে রয়েছে অভিমান হওয়ার সমস্ত ট্রিগার পয়েন্ট।
অভিমানকে বিজ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করলে...
ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, মানুষ ঠিক কোন পরিস্থিতিতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নিয়ন্ত্রিত হয় তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও মস্তিষ্কের গঠনের মাধ্যমে। আর এখানেই চলে আসে স্ট্রেস ডায়াথিসিস মডেলের কথা।
নিউরোডেভেলপমেন্টাল (স্নায়বিক বিকাশ), নিউরোকেমিক্যাল (মস্তিষ্কের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এমন হরমোন) ও নিউরোঅ্যানাটমিক্যাল (মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের গঠন) কারণের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশের প্রভাব, যা সূক্ষ্ম ভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক কোন বিষয়ে একজন ব্যক্তি অভিমান করবেন। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকে পরিবেশের।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দু’জন মানুষ কখনওই একই বিষয়ে এক রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। যদি কারও মস্তিষ্কের গঠনের মধ্যে সহজে অভিমান করার প্রবণতা থাকে, কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাঁকে সে সুযোগ না দেয়… তাঁর কখনও অভিমান হবে না।
কেন সম্পর্ক ছেড়ে চলে যায় মানুষ?
অভিমানের প্রকাশ আসলে বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো চারিত্রিক বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। সঙ্গে গুরুত্ব পায় পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার ছায়াও। এই অভিজ্ঞতা লিম্বিক সিস্টেমের হিপোক্যাম্পাসে সঞ্চিত থাকে। যদি পুরনো ঘটনার ছায়া জীবনে পুনরায় এসে পড়ে, তবে এই হিপোক্যাম্পাস তা জানান দেয় অ্যামিগডালাকে। সেখান থেকেই সূচনা হয় অভিমানের।
বিশেষ করে কম আত্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। হয়তো বড় হয়ে ওঠার সময়ে ক্রমাগত তাঁকে ছোট করা হয়েছে। তাই তাঁর অভিমানের প্রকাশ গুটিয়ে যাওয়া, নিজেকে অযোগ্য ভেবে সম্পর্ক থেকে নীরবে সরে যাওয়া।
যাঁর অহমিকা রয়েছে, তাঁর অভিমানের প্রকাশে স্পষ্টতই দেখা যায় প্যাসিভ অ্যাগ্রেশনের ছাপ। সেখান থেকেই কথা কাটাকাটি ও তিক্ততা বৃদ্ধি পায় সম্পর্কে। এক সময়ে আলাদা হয়ে যায় দু’জনের রাস্তা।
আবার কখনও অভিমানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে হতাশা ও ক্লান্তি। মানুষ তখন নিজে থেকে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চায়।
অভিমান টের পেলে সামলাবেন কী করে?
• কথা বলুন: যে মুহূর্তে বুঝতে পারছেন আপনার বন্ধুর ব্যবহার অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করুন তাঁর কী হয়েছে। সব সম্পর্কেই খোলাখুলি কথা বলার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
• বিশ্লেষণ করুন: অনেক সময়ে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না ঠিক কী কারণে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনা নিজের মনে একবার বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন। ভুল বোঝাবুঝি ও অভিমানের মূল সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
• অহমিকা দেখাবেন না: আপনি বুঝতে পারছেন অপরজনের অভিমানের কারণ। কিন্তু অহমিকা আপনাকে এগোতে দিচ্ছে না। এটা করবেন না। যুক্তি দিয়ে বিচার করুন। মনে রাখবেন, বন্ধুত্বের গুরুত্ব অহমিকার চেয়ে বেশি। অপরজনের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝলে, আপনার লাভ বই ক্ষতি হবে না।
• জোর করবেন না: যদি দেখেন, উল্টো দিকের মানুষটি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে সম্পর্ক না রাখার, জোর করবেন না। প্রত্যেকটি সম্পর্কের একটি সময়সীমা থাকে, সেটা পার হয়ে গেলে আলাদা হয়ে যেতেই হয়।
দীর্ঘস্থায়ী অভিমান যে কোনও সম্পর্কের পক্ষে বেশ ক্ষতিকারক, তাই যে কোনও সম্পর্কে অভিমানের সূচনা দেখলে তা মিটিয়ে ফেলাই মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।