Spinal Cord Problem

সোজা থাকুক মেরুদণ্ড

নিয়মিত শারীরচর্চা অনেকাংশেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

Advertisement

কোয়েনা দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৩০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

ছোট থেকে দুই পা পিছনে মেলে ইংরেজি বর্ণ ‘ডব্লিউ’-এর মতো করে বসে কোকো। ফলে হাঁটু ও নিতম্বে ক্রমাগত চাপ পড়ায় অল্প বয়সে আর্থ্রাইটিসের শিকার কোকো। ওরই স্কুলে পড়ে তাতাই। বয়সে একই হলেও, তাতাই বেশ লম্বা। কিন্তু ক্রমশ কুঁজো হয়ে যাচ্ছে ও। চিন্তায় ওর অভিভাবকরা। এক নামী আইটি কোম্পানির উচ্চপদে চাকুরিরত সীমান্তের আবার ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে এখনও। দিনের আট থেকে দশ ঘণ্টা সময় কাটে চেয়ার-টেবিলে বসেই। কাজ সেরে উঠলে কোমরে ব্যথায় দাঁড়াতে কষ্ট হয়। অনেক দিন ধরেই মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছে অরিত্রা। চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও, দাঁড়াতে, চলতে অসহ্য যন্ত্রণায় দিন কাটছে।

Advertisement

সমস্যার কারণ

ফিটনেস বিশারদ সৌমেন দাস বলছেন, “এখন আট থেকে আশি প্রায় সকলেই কোমরে ব্যথা, শিরদাঁড়ায় সমস্যা, কুঁজো হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছেন। এর পিছনে দায়ী সচেতনতার অভাব এবং অনেকটাই দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। ছোটবেলায় অনেক সময়েই বাচ্চারা ভুল ভঙ্গিতে বসে। সঙ্গে রয়েছে ভারী স্কুল ব্যাগ। অভিভাবকেরা যথা সময়ে সচেতন হন না। ফলে সে অভ্যেসই দীর্ঘকালীন সমস্যার জন্ম দেয়। তা ছাড়া, সময়ের সঙ্গে বদল এসেছে আমাদের কাজের ধরন, রুটিনে। বিকেল হলেই মাঠে যাওয়া, খেলাধুলো, দৌড়ঝাঁপ, সাঁতার, ক্রিকেট বাদ গিয়েছে অনেক দিন। এখন চেয়ার-টেবিলে ঘাড় গুঁজেই সময় কাটে অধিকাংশের। ফলে যেমন শারীরিক ভঙ্গিতে আসছে বিকৃতি, তেমনই দেখা দিচ্ছে নানা গুরুতর সমস্যা।

Advertisement

সমাধানের উপায়

সমস্যা গুরুতর হলেও, এর সমাধান কিন্তু সহজ। চিকিৎসকের পরামর্শ তো বটেই, সঙ্গে নিয়মিত শারীরচর্চা অনেকাংশেই মুক্তি দিতে পারে। সৌমেন বলছেন, “স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা এবং শরীরের ভঙ্গিগত সমস্যা, শারীরচর্চায় দুইই ঠিক হতে পারে।”

শারীরিক ভঙ্গিমার জন্য শারীরচর্চা

সাধারণ ভাবে ভুল জীবনযাপন, শরীরের ভুল ভঙ্গি (পশ্চার) থেকে স্পাইনাল কর্ডের সমস্যা শুরু হয়। তাই সে দিকেই প্রাথমিক নজর দেওয়া প্রয়োজন।

  • চাইল্ড পোজ়: শিশুর হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে মেঝেতে বসুন। এ বার পশ্চাদ্দেশ পায়ের গোড়ালির উপর রেখে, কপাল মাটিতে ঠেকান। হাত দুটো পিছনে নিয়ে তালু উল্টো করে পায়ের কাছে রেখে দশ গুনুন। রোজ অন্তত পাঁচ সেট করুন এই ব্যায়াম।
  • হাই প্ল্যাঙ্ক: প্রথমে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ুন। এ বার দুই পায়ের পাতা এবং হাতের তালুর ভরে শরীরটাকে মাটি থেকে উপরের দিকে তুলুন। লক্ষ্য রাখবেন, হাঁটু এবং কনুই যেন ভাঁজ না হয়। উপর বা নীচে নয়, দৃষ্টি রাখুন একেবারে সোজা। এই অবস্থায় পনেরো গুনুন। তারপর দশ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে আবার করুন।
  • সাইড প্ল্যাঙ্ক: একই ভাবে মাটিতে ডান পাশ ফিরে শুয়ে পড়ুন। এ বার ডান পা এবং ডান হাতের উপরে ভর দিয়ে শরীরটা উপরের দিকে তুলুন। বাঁ পা সমান্তরাল ভাবে ডান পায়ের উপরে রাখুন। বাঁ হাত রাখুন তার উপর। এই অবস্থায় দশ গুনুন। পাঁচ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে অন্য পাশ ফিরে করুন। চাইলে সাইড প্ল্যাঙ্কে প্রশিক্ষকের পরামর্শে হাত-পায়ের অবস্থান ভঙ্গিতে সামান্য বদলও আনতে পারেন।
  • গ্লুট ব্রিজ: এ বার চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে হাঁটু থেকে পা দুটো ভাঁজ করে নিন। হাত দুটো শরীরের দুই পাশে সোজা রাখুন। মাটিতে মাথা রেখে পায়ের উপর ভর দিয়ে কোমর থেকে শরীর উপরের দিকে তুলুন। এই অবস্থায় দশ গুনুন। বিশ্রাম সহ নিয়মিত তিন সেট করুন এই ব্যায়াম।
  • ক্যাট অ্যান্ড কাউ স্ট্রেচ: প্রথমে চার হাতে পায়ে ভর দিয়ে বসুন। হাতের পাতা ও হাঁটুকে সমান্তরালে রাখুন। এ বার প্রথমে মাথা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে পিঠ উঁচু করুন। কুড়ি সেকেন্ড এই অবস্থায় থেকে মাথা যতটা সম্ভব উপরের দিকে তুলুন। সে সময় পেট নামিয়ে আনুন মাটির কাছাকাছি। খেয়াল রাখবেন, হাত যেন কনুই থেকে ভাঁজ না হয়।
  • ফরোয়ার্ড ফোল্ড টিল্ট: দুই পায়ের উপর সোজা হয়ে দাঁড়ান। হাত রাখুন মাথার উপর। এ বার হাঁটু না ভাঁজ করে কোমর থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে হাত রাখুন মাটিতে। এই অবস্থায় দশ গুনুন। দিনে তিন থেকে চার সেট করতে পারেন এই ব্যায়াম।

এ ছাড়াও, শারীরিক ভঙ্গিমা ঠিক করতে, কুঁজো হয়ে যাওয়া এড়াতে চেস্ট ওপেনিং, স্ট্যান্ডিং ক্যাট অ্যান্ড কাউ, ডাউনওয়ার্ড ফেসিং ডগ ইত্যাদি ব্যায়ামও করতে পারেন।

মেরুদণ্ডের সমস্যায় শারীরচর্চা

স্পাইনাল কর্ডের সমস্যা কিন্ত এখন সাধারণ। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেও রয়েছে একাধিক ব্যায়াম। রোটেশনাল স্ট্রেচ, পেলভিক টিল্ট, ব্রিজ, শোল্ডার ব্লেড স্কুইজ়, ক্যাট অ্যান্ড কাউ স্ট্রেচ-সহ নানা ব্যায়ামে মিলতে পারে আরাম।

  • রোটেশনাল স্ট্রেচ: পিঠ, কোমরের ব্যথা সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যায় এই ব্যায়ামের জুড়ি মেলা ভার। প্রথমে দুই পা ফাঁক করে, দুই হাত দু’দিকে প্রসারিত করে দাঁড়ান। এ বার ডান হাত দিয়ে ডান পায়ের পাতা স্পর্শ করুন। বাঁ হাত তখন রাখুন কাঁধ বরাবর উপরের দিকে। আপনার দৃষ্টিও রাখুন বাঁ হাতের দিকেই। ঠিক দু’-তিন সেকেন্ড এই অবস্থায় থেকে এ বার বিপরীত দিকেও একই কাজ করুন। এ ছাড়াও, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে তো বটেই অন্য নানা ভঙ্গিতেও এই স্ট্রেচ করা সম্ভব।
  • পেলভিক টিল্ট: প্রথমে মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। এ বার কোমর মাটিতে রেখে এক এক করে দুই পা মাটি থেকে তুলুন। কোমরের সঙ্গে সমকোণে পা ধরে থাকুন দশ সেকেন্ড। হাত রাখুন দেহের দুই পাশে। এ বার ডান পা নামিয়ে দেহের সঙ্গে সমান্তরালে রাখুন পাঁচ সেকেন্ড। ডান পা তুলে বিপরীত পায়েও একই পদ্ধতি অবলম্বন করুন। নিয়মিত দশ মিনিট এই শারীরচর্চা করুন।
  • শোল্ডার ব্লেড স্কুইজ: মাথা ও কোমর সোজা করে দাঁড়ান। কাঁধের দু’পাশে কনুই থেকে ভাঁজ করে হাত রাখুন। হাতের তালু কাঁধের সমান্তরালে, অপেক্ষা করতে বলার ভঙ্গিতে রাখুন। এ বার দুই কাঁধকে টেনে ধরুন পিছনের দিকে। দশ সেকেন্ড এই ভাবে ধরে থাকুন। পাঁচ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় একই ভাবে করুন।
  • চিন টু চেস্ট স্ট্রেচ: এই শারীরচর্চার শুরুতে মাথা রাখুন সোজা। এ বার ধীরে ধীরে মাথা নামিয়ে চিবুক ঠেকান বুকে। এই অবস্থায় দশ গুনুন। ঘাড়ের শিরায় টান লাগলে আস্তে আস্তে মাথা তুলে আবারও সোজা করুন। একটু বিশ্রাম নিয়ে এই পদ্ধতি দিনে অন্তত পাঁচ বার করুন।

এ ছাড়াও ব্রিজ, ক্যাট অ্যান্ড কাউ স্ট্রেচ, অ্যাবডোমিনাল কার্ল ইত্যাদিও করতে পারেন।

শারীরিক ভঙ্গিতে ত্রুটি বা স্পাইনাল কর্ডের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়মিত অন্তত ৪৫ মিনিট অবশ্যই করতে হবে শারীরচর্চা। পরে তা বাড়ানো যেতে পারে। সঙ্গে প্রয়োজন সচেতনতারও। সৌমেনের মতে, ভারী ব্যাগ, বইয়ের পাতায় মুখ গোঁজা জীবনযাপন বদলানো অসম্ভব, আগের মতো এখন আর বিকেলে মাঠে খেলতেও যায় না কেউ। তবে বয়স বাড়লে, একবার কুঁজো হয়ে গেলে, মেরুদণ্ডের সমস্যা শুরু হলে বা শারীরিক ভঙ্গিতে সমস্যা দেখা দিলে তা মেটানো কঠিন। তাই অল্প বয়স থেকেই যদি নিয়মিত শারীরচর্চা করা হয়, তা হলে এ সমস্যা কিন্তু অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হবে। তবে মেরুদণ্ডের সমস্যায় শারীরচর্চা করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। নয়তো ভুল শারীরচর্চায় যন্ত্রণা কমার বদলে বাড়তে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement