Lifestyle News

‘স্নায়ু’যুদ্ধ জয়ের উপায়

শৈথিল্য বা সংবেদন কমে আসা বার্ধক্যের চেনা সমস্যা। এই ধরনের স্নায়ুরোগেও দিব্যি ভাল থাকা যায় শৈথিল্য বা সংবেদন কমে আসা বার্ধক্যের চেনা সমস্যা। এই ধরনের স্নায়ুরোগেও দিব্যি ভাল থাকা যায়

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২০ ০০:২৪
Share:

লীলাদেবী বারান্দায় গিয়ে দেখলেন, তাঁর গৃহকর্ম সহায়িকা চাঁদনি পাশের গলি দিয়ে কেটে পড়ছে। লীলাদেবী তেড়েফুঁড়ে তাকে ডাকতে গিয়ে মহা আতান্তরে পড়লেন। কিছুতেই মেয়ের নাম মনে পড়ে না। শেষে প্রাণপণে চেঁচালেন, ‘বাসন্তী, ও বাসন্তী।’ তার পর, ‘অ্যাই মিলি, না জুলি, না তো দামিনী...’। পুরো বলিউড দৌড়ে আসার আগে চাঁদনি ব্যাজার মুখে পিছু ফিরল, লীলাদেবী হাঁপ ছাড়লেন।

Advertisement

বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটাটা কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ ওটা পাওয়া গেল বেডকভারের নীচেই। দাদু দিব্যি ঝাঁটার উপরে বসে ঢুলছিলেন। সবাই চেঁচাল, ‘ঝাঁটার উপরে বসেছিলে, ব্যথা লাগেনি?’ দাদু অবাক, পায়ের চামড়ায় ঝাঁটার কাঠির লাল দাগ হয়ে গিয়েছে।

নাতির জন্মদিন। মিসেস সেন গ্লাসের বদলে বেয়ানের শাড়ি-গয়নায় জল ঢেলে দিলেন। শীতের রাতে বেয়ান ঠকঠক করে কাঁপছেন আর সেনগিন্নি আমতা আমতা করছেন, হাতটা কেঁপে গেল যে!

Advertisement

মস্তিষ্কের ব্যায়াম

দাবা খেলুন। সুদোকু, ক্রসওয়ার্ড সমাধান করুন। নাতি-নাতনির পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারেন। সিরিয়াল দেখার সময় কমিয়ে গোয়েন্দা ছবি বা সিরিজ়, কুইজ় শো দেখুন। মস্তিষ্কের ধূসর কোষ সতেজ থাকবে। কগনিটিভ প্রবলেম কমবে

ঘটনাগুলি মজার ঠিকই। কিন্তু মোটেই হেসে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। আঘাত লাগলে বাড়ির বয়স্করা তখনই বুঝতে পারছেন না, ভুলো আর শ্লথ হয়ে যাচ্ছেন, হাত থেকে জিনিস ফেলে দিচ্ছেন— এ ধরনের ঘটনায় সতর্ক হোন। হতেই পারে, মানুষটির স্নায়ুর অসুখ শুরু হচ্ছে। এই অসুখের মুশকিল হল, এর উপসর্গ এমনই বিচিত্র যে, গোড়ায় অসুখ বলে টেরই পাওয়া যায় না। রোগী নিজেও বুঝতে পারেন না যে, তাঁর আদৌ কোনও অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু একটু সজাগ হলে উপসর্গ ধরতে পারা যায়। যেমন কোথাও ধাক্কা লাগলে দু’বছরের বাচ্চা তখনই কঁকিয়ে ওঠে। বয়স্ক মানুষ আঘাত পেলে তখনই এতটা তীক্ষ্ণ ভাবে অনুভব না-ও করতে পারেন। পরে একটু ব্যথা লাগতে হয়তো দেখলেন, কালশিটে পড়েছে।

পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়ন্ত রায় বললেন, বয়সের সঙ্গে শরীরের সংবেদন কমতে থাকে। অবশ ভাব আসে। হাত থেকে জিনিস পড়ে যায়। হাত-পা কাঁপে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধ দিয়ে স্নায়বিক সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। বয়সে নার্ভের সমস্যার বেশ কিছুই পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি। মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড থেকে স্নায়ু বেরিয়ে বার্তা ও সংবেদন শরীরের নানা অংশে পৌঁছে দেয়। নার্ভ যাত্রাপথে বাধা পেলে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির লক্ষণ দেখা দেয়। যেহেতু বয়সের সঙ্গে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে, তাই সেই সব অসুখের সঙ্গে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির সম্ভাবনা বাড়ে। তিন ধরনের পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বেশি দেখা যায়।

ডায়াবিটিক নিউরোপ্যাথি: মধুমেহ রোগ থাকলে এই ধরনের নিউরোপ্যাথি দেখা দিতে পারে। কারও কম, কারও বেশি মাত্রায় রোগটি হয়। শরীর দুর্বল, অসাড় লাগে। প্রতিবর্ত ক্রিয়া ভীষণ কমে যায়। রোগী চট করে ঘুরতে, উঠতে বা বসতে পারেন না। এই ধরনের নিউরোপ্যাথি প্রায় কখনওই পুরোপুরি সারে না।

কার্পাল টানেল সিনড্রোম: হাতের কব্জির স্নায়ুতে চাপ পড়ার কারণে দুটো হাত ঝিমঝিম করে ও অবশ হয়ে যায়। খুন্তি ধরতে, পেন ধরতে বা মোবাইল হাতে নিতে সমস্যা হয়।

সার্ভাইকাল স্পন্ডিলোসিস স্পাইনাল কর্ড ডিজ়িজ়: এই রোগের প্রথম লক্ষণ পায়ে দেখা দেয়। রোগী ঠিক করে হাঁটতে পারেন না। পায়ের তলায় কাঁকর পড়ল কি না বা নীচের মেঝেটা সমান না অসমান, তা বুঝতে পারেন না। ফলে পা থেকে চটি খুলে খুলে বেরিয়ে যায়। পা থেকে হাতে, হাত থেকে শরীরের নিম্নাংশে পর্যন্ত এই নিউরোপ্যাথি চলে যায়। পক্ষাঘাত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

অসুখের কারণ ও প্রতিকার

নানা ধরনের অসুখ থাকলে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হতে পারে। হয়তো ৬৬ বছরের কোনও মহিলা অনেক দিন ধরে মধুমেহ রোগে ভুগছেন। তাঁর ওজন বেশি, হাঁটুতে সমস্যা আছে। ফলে তিনি সচল নন। তাঁর কিন্তু ডায়াবিটিক নিউরোপ্যাথি হলেই শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। ডায়াবিটিকদের ক্রনিক কিডনি ডিজ়িজ়ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথিও বেড়ে যাবে।

কিছু কিছু ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহার এই রোগের অনুঘটক। ক্যানসারের কেমোথেরাপির কিছু ওষুধের, কড়া ডোজ়ের অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অসুখটি হতে পারে। অনেকেই পেটের অসুখ হলে বাজারচলতি ওষুধ কিনে খেয়ে নেন। এমন অভ্যেস বহু দিন থাকলে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হতে পারে। মদ্যপানের অভ্যেস, পুষ্টি উপাদান ও ভিটামিনের অভাবেও রোগটি দেখা যায়।

কোনও কোনও পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি সারে বা উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। রোগের তীব্রতা বেশি হলে তা না সারতেও পারে। রোগীর অসুখ কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা বুঝে চিকিৎসক পরামর্শ দেন।

প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা কমছে?

বয়সজনিত কারণে মস্তিষ্কের সজাগ থাকা, কোনও আঘাতে প্রতিক্রিয়া জানানোর কর্মক্ষমতা কমে যায়। চিকিৎসকরা বলেন, কগনিটিভ ডিক্লাইন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মানুষটি বেখেয়ালি হয়ে যান। টুকটাক কেটেছড়ে গেলে সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেন না। ৭০-৮০ বছর বয়সে অনেকটাই কগনিটিভ ডিক্লাইন হয়। আর্লি ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রেও এই সংবেদন, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা কমে যায়। রিফ্লেক্স মেকানিজ়মেও সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিবর্ত ক্রিয়া শরীরকে চোট আঘাত থেকে বাঁচায়। এটি এক ধরনের ডিফেন্স মেকানিজ়ম। এটি কমে গেলে পড়ে যাওয়ার, লেগে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।

আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ, সক্রিয় বয়স্ক মানুষও কোনও মুহূর্তে কথার খেই হারিয়ে ফেলেন, নাম মনে রাখতে সমস্যায় পড়েন। এ ভাবে শুরু হয় মিনিমাল কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট। এই রোগাক্রান্তদের এক শতাংশের সম্পূর্ণ ডিমেনশিয়া বা অ্যালজ়াইমার্স জাতীয় অসুখ হতে পারে।

তা হলে উপায়?

অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের অসুস্থতা সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কগনিটিভ প্রবলেম বা পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অন্তরায় নয়। চিকিৎসা করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, পঙ্গু হওয়ার ভয় কম থাকে। স্বাস্থ্যকর অভ্যেস মেনে চললে এই রোগ অনেকাংশেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে। সুস্থ জীবনাভ্যাস বলতে যোগাভ্যাস, হাঁটাহাঁটি, ধূমপান ও মদ্যপানে বিরত থাকা, পরিমিত আহার, ওজন কম রাখা ইত্যাদি। সত্তর বছর বয়সেও এই নিয়মগুলি মানলে স্নায়ুর সমস্যা বশে থাকবে। অবসর জীবনেও সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন। বাড়ির কাজের মধ্যে থাকুন।

নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাড়ির বয়স্ক মানুষটির রুটিন স্বাস্থ্যপরীক্ষা জরুরি। স্নায়ুর যে সমস্যাগুলি আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, তা চিহ্নিত করা যাবে। স্নায়ুর অসুখেও সহজেই লাগাম পরানো যাবে।

মডেল: রেবা দত্ত, নিকুঞ্জবিহারী পাল, ছবি: জয়দীপ মণ্ডল, মেকআপ: দীপ্তি বন্দ্যোপাধ্যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement