কিডনির যে কোনও ধরনের প্রদাহকে বলা হয় নেফ্রাইটিস। অর্থাৎ কিডনির যে কোনও সমস্যাকে এই গোত্রে ফেলা হয়। সাধারণ মানুষ নেফ্রাইটিসকে একটিই রোগ বলে ধরে নেন। তবে এটি কিডনির বিভিন্ন অংশবিশেষে হতে পারে। কিডনির গ্লোমেরুলাসে নেফ্রাইটিস হলে এটিকে বলা হয় গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস। কিডনির টুবুলো ইনটারস্টিশিয়াল অংশে হলে, সেটিকে বলা হয় পাইলো নেফ্রাইটিস। দু’টি ক্ষেত্রেই ক্রনিক এবং অ্যাকিউট প্রকৃতির হতে পারে। ক্রনিক মানে যা তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলবে। অনেক ক্ষেত্রে ক্রনিক উপসর্গ নির্মূল করা যায় না, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। অ্যাকিউট মানে যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হয়েছে এবং উপশম সম্ভব।
নেফ্রাইটিসের কারণে কিডনির কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। কিন্তু তা কত দ্রুত হারে কমবে, তা অনেকটাই রোগীর সচেতনতা এবং শুভবুদ্ধির উপরে নির্ভর করে। ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া, ধূমপান, অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তি, কায়িক শ্রমের অভাব, অতিরিক্ত ওজন— প্রতিটি ফ্যাক্টর কিডনির উপরে চাপ সৃষ্টি করে। কিডনির কোনও সমস্যা থাকলে তা আরও ত্বরান্বিত করে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এই ফ্যাক্টরগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেই কিডনির কার্যক্ষমতা পাঁচ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তখন ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করা ছাড়া চিকিৎসার পথ থাকে না। কিন্তু নিয়ম মেনে চললে, রোগী দীর্ঘ সময় ধরে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।
গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস
* অ্যাকিউট গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস: শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সকলেরই হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে মূলত কোনও সংক্রমণের পরবর্তী পর্যায়ে এই ধরনের নেফ্রাইটিস দেখা যায়। স্ট্রেপটোকক্কাই নামের একটি ব্যাকটিরিয়া যখন ত্বকে বা গলায় সংক্রমণ ঘটায়, তখন সেই ব্যাকটিরিয়ার প্রতিরোধে শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করে। ব্যাকটিরিয়ার অ্যান্টিজেন এবং শরীরের অ্যান্টিবডি মিলে জটিল যৌগ তৈরি হয়ে যখন কিডনির পথ দিয়ে নির্গত হওয়ার চেষ্টা করে, তখন তা কিডনিরও ক্ষতি করে।
উপসর্গ: মূত্রের পরিমাণ কমে যায়, শরীর ফুলে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, ইউরিনের রং পরিবর্তিত হয় (অনেকটা কালচে জাতীয়), মূত্রের সঙ্গে রক্তও পড়তে পারে।
কোন বয়সে বেশি দেখা যায়? সাত-আট বছর বয়সের শিশু থেকে সতেরো-আঠেরো বছর বয়স পর্যন্ত এটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিডনির কার্যক্ষমতা কতটা হ্রাস পাচ্ছে, তার ভিত্তিতে এই রোগের ‘মাইল্ড’, ‘মডারেট’ বা ‘সিভিয়ার’ ডায়গনোসিস হয়। তিরিশ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হলে ‘মাইল্ড’, সত্তর-আশি শতাংশ হলে ‘মডারেট’ এবং তার বেশি হলে ‘সিভিয়ার’।
চিকিৎসা: সিভিয়ার হলে ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হয়। তা না হলে ছ’-আট সপ্তাহের মধ্যে রোগটি সেরে যায়। ওষুধ দিয়েই মূলত চিকিৎসা হয়।
নেফ্রোলজিস্ট ডা. ললিত আগরওয়ালের মতে, ‘‘একশো শতাংশ রোগীর অ্যাকিউট ক্লাসিকাল গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস হলে, তার মধ্যে দশ শতাংশ রোগীর তা ক্রনিকে পর্যবসিত হয়। ক্রনিক হওয়া মানে কিডনির ভিতরে ক্ষতির কাজটা মলিকিউলার পর্যায়ে চলতেই থাকে। কিডনির আশি শতাংশ কার্যক্ষমতা হ্রাস না পেলে রোগী সাধারণত এর উপসর্গগুলি বুঝতে পারেন না। তাই যখন তাঁরা চিকিৎসকের কাছে আসেন, তখন হয়তো অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গিয়েছে দেখা যায়।’’
সেকেন্ডারি গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস
ডা.আগরওয়ালের মতে, কিছু ক্ষেত্রে যেমন গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিসের কারণ বোঝা যায়। কয়েকটি ক্ষেত্রে এর কারণ আবার বোঝাও যায় না। তখন সেটিকে বলা হয় সেকেন্ডারি গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস। এ ক্ষেত্রে রোগ কিডনির ভিতরে নয়, বাইরে। কিন্তু সেই রোগের কারণে কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন, কোলাজেন ভাসকুলার ডিজ়িজ় এসেলির (সিস্টেমিক লুপাস এরিটোমেটোসিস) কারণে কিডনি গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস, প্যারাসাইটঘটিত সংক্রমণের কারণেও সেকেন্ডারি গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস হতে পারে।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম
কয়েকটি রোগ রয়েছে, যা সরাসরি নেফ্রাইটিস নয়। তবে এগুলির কারণেও গ্লোমেরুলাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটিকে বলা হয় নেফ্রোটিক সিনড্রোম।
উপসর্গ: এই রোগে মূত্রের সঙ্গে প্রোটিন নির্গত হয়। এর ফলে রোগীর মুখ-শরীর ফুলে যায়। রক্তে অ্যালবুমিনের পরিমাণ কমে যায়, কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায়।
কারণ: সুস্থ ব্যক্তির মূত্রের সঙ্গে প্রোটিন নির্গত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিডনির ফিল্টারগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে যা নির্গত হওয়ার কথা নয়, তা রোগীর শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মূত্রের সঙ্গে তিন গ্রামের বেশি প্রোটিন নির্গত হলে, রোগীর নেফ্রোটিক সিনড্রোম রয়েছে।
কোন বয়সে বেশি দেখা যায়?
শিশু থেকে বয়স্ক যে কোনও ব্যক্তির হতে পারে। তবে বয়সের সঙ্গে রোগের কারণ বদলাতে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে ‘মিনিমাল চেঞ্জ নেফ্রোটিক সিনড্রোম’ হয়। মাঝারি বয়সিদের ‘মেমব্রেনেস’ রোগের কারণে হতে পারে। বৃদ্ধদের মেমব্রেনেস, অ্যামাইলয়েডোসিস, ক্যানসার-জাতীয় রোগের কারণেও নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে।
পাইলো নেফ্রাইটিস
কিডনির টুবুলো ইনটারস্টিশিয়াল কমপার্টমেন্টে নেফ্রাইটিস হলে তা পাইলো নেফ্রাইটিস। এটি অ্যাকিউট ও ক্রনিক দুই প্রকৃতির হতে পারে। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন এই গোত্রের। একটি কিডনি বা দু’টি কিডনিতেই সংক্রমণ হতে পারে। উপসর্গ: কোমরে ব্যথা, ধুম জ্বর, মূত্রের সঙ্গে রক্ত নিঃসৃত হওয়া।
কোন বয়সে বেশি হয়?
শিশু, বৃদ্ধ ব্যক্তিদেরও হতে পারে। তবে তার কারণ আলাদা হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে মূত্র যদি নির্গত না হয়ে পিছন পথে ফেরত আসে, তখন মূত্র জমে কিডনির ক্ষতি করে, সংক্রমণ ঘটায়। সাধারণত মূত্র নির্গত হওয়ার পথে কোনও ভালভ থাকে না। কিন্তু এই রোগ থাকলে ভালভ তৈরি হয়ে যায়, যার কারণে মূত্র নির্গত হতে বাধা দেয়।
ডায়াবেটিক রোগী ও মহিলাদের মধ্য বয়সে পাইলো নেফ্রাইটিস বেশি হয়। কিডনিতে স্টোনের জন্য, ম্যালিগন্যান্সির জন্য বা প্রস্টেট বড় হয়ে গেলে বৃদ্ধ বয়সে এই রোগ হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই মূত্র নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সংক্রমণ হয়, কিডনির প্যারেনটাইমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
চিকিৎসা: এ ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে অ্যান্টি-বায়োটিক দেওয়া হয়। অন্যান্য আনুষঙ্গিক ওষুধের প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতি গুরুতর পর্যায়ের হলে, ডায়ালিসিসের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন রোগী। এই রোগ যদি তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলে, তখন তা ক্রনিক বলে গণ্য হয়।
সংক্রমণ ছাড়াও পাইলো নেফ্রাইটিস
ডা. আগরওয়ালের মতে, ‘‘অনেকেই কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া পেনকিলার খেতে থাকেন, যা কিডনির ক্ষতি করে। অনেক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে শরীরে টক্সিন প্রবেশ করতে পারে, যা কিডনির ক্ষতি করে। এ সব ক্ষেত্রে কিডনির ভিতরে মলিকিউলার পর্যায়ে পাইলো নেফ্রাইটিস ছড়াতে থাকে।’’
ডায়ালিসিস পর্যায়ে যাওয়ার আগে অবধি চিকিৎসকেরা ওষুধ দিয়ে রোগটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, উপসর্গ কমানোর চেষ্টা করেন। তাই রোগীর সতর্ক থাকাও এখানে আশু কর্তব্য।