শ্যামসুন্দর জিউ পোস্তা রাজবাড়ির বিগ্রহ।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনটি আজও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জন্মাষ্টমীর রেশ বৃন্দাবন, মথুরা, গোকুল কিংবা দ্বারকার সীমানা ছাড়িয়ে আসমুদ্র হিমাচল ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলায় এই উৎসবের ইতিহাস বহু প্রাচীন। ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণ বা গোপাল হয়ে উঠেছেন ভক্তের ভগবান। আর সেই বিশ্বাসের সূত্র ধরেই তিনি ভক্তদের কাছে দেবতা থেকে ঘরের আপনজনে পরিণত হয়েছেন। তাই তার পুজো-পার্বণের সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা লৌকিক আচার অনুষ্ঠানও।
বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরের বিভিন্ন মন্দির ও পরিবারে আজও সাড়ম্বরে পালিত হয় এই উৎসবটি। যেমন বড় গোস্বামীবাড়ি। ইতিহাস বলে প্রায় হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন শ্রীরাধারমণ বিগ্রহটি। শোনা যায়, এই কৃষ্ণমূর্তিটি পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামে পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে যশোরের রাজা বসন্ত রায় মূর্তিটি যশোরে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করায় বসন্ত রায়ের পরিবার মূর্তিটির পবিত্রতা রক্ষায় সেটিকে তাঁদের গুরুদেব শ্রীঅদ্বৈতের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মথুরেশ এই বিগ্রহটি শান্তিপুরে নিয়ে এসে নিজগৃহ, গোস্বামী বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় তিনশো বছর আগে শ্রীমতীর বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই পরিবারের সত্যনারায়ণ গোস্বামী বলছিলেন, ‘‘প্রাচীন প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমী উৎসব শুরু হয় চাঁদ দেখে সন্ধ্যায়। পুজোর মধ্যে আছে লোকাচার। যেমন শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, নাড়ি কাটা ইত্যাদি। পুজো শেষ হয় গভীর রাতে। প্রতিটি বিগ্রহ স্নান করিয়ে সেগুলির অভিষেক করা হয়। পরের দিন হয় নন্দোৎসব। সকাল থেকেই নিবেদন করা হয় নানা ধরনের ভোগ। এ দিন সেবায়েত সহ পাড়া-পড়শিরা শুদ্ধাচারে বিভিন্ন মিষ্টি তৈরি করে এনে তা বিগ্রহের সামনে নিবেদন করেন। নানা ধরনের মিষ্টি ছাড়াও থাকে ক্ষীর, ছানা ও মাখন। এখানে জন্মাষ্টমীর আরও এক আকর্ষণ ঝাল নাড়ু। চালের গুঁড়ো, ঘি, গোলমরিচ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি।’’
শান্তিপুরের অন্যতম প্রাচীন শ্যামচাঁদ মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সারা দিন হয় নাম সংকীর্তন। সে দিন দুপুরে অন্নভোগের পরে রাধারানিকে সরিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট তিথি ও আচার অনুষ্ঠান মেনে আঁতুরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পরে নাড়ি কাটা অনুষ্ঠিত হয়। পুরনো প্রথা অনুসারে সদ্যোজাত ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যেমন তার নাড়ি কাটা হয় তেমনই গৃহদেবতার উদ্দেশে হলুদ সুতো কাটা হয় চাঁচারি দিয়ে। শৈশবাবস্থার কথা ভেবেই রুপোর তৈরি বিভিন্ন খেলনা দেওয়া হয়। ১০০৮টি তুলসীপাতা চন্দন মাখিয়ে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়। জন্মাষ্টমীর বিশেষ ভোগে থাকে তালের বড়া, লুচি, সুজি, পায়েস, মালপোয়া, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি। পরের দিন সাড়ম্বরে পালিত হয় নন্দোৎসব।
আরও পড়ুন: জন্মাষ্টমীতে দেখে নিন রাধাকৃষ্ণ
কাঁচরাপাড়া ও কল্যাণীর সংযোগস্থলে কৃষ্ণরাই জিউর মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আজও দূর-দুরান্ত থেকে বহু ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। জন্মাষ্টমীর রাতে মন্দিরের পিছনে রন্ধনশালায় নারায়ণ শিলাকে নিয়ে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্মানুষ্ঠান, নাড়ি কাটা-সহ ধাপে ধাপে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পুজোর শেষে হোম করা হয়। পরের দিন পালন করা হয় নন্দোৎসব।
মফসসলের পাশাপাশি কলকাতার কিছু বনেদি পরিবারেও ঐতিহ্য মেনে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। এই দিন শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউর ষোড়শোপচারে বিশেষ পুজো ও হোম হয়। গোবিন্দজিউকে নতুন কাপড় ও অলঙ্কার পরানো হয়। থাকে তাল-সহ বিশেষ নৈবেদ্য। পর দিন জাঁকজমক সহকারে পালন করা হয় নন্দোৎসব। অতীতে জন্মাষ্টমী আরও জাঁকজমক সহ পালন করা হত। আগে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা রং চং মেখে মুকুট, গয়না পরে নন্দ সাজত। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখাত। এই উপলক্ষে একটা বড় জালায় হলুদ গোলা হত। সেটা সবার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হত। কাউকে কাউকে স্নানও করিয়ে দেওয়া হত। এখনও পুরোহিতমশাই সেই হলুদ জল ছিটিয়ে দেন। এ দিনও নতুন করে গোবিন্দজিউকে সাজানো হয়। আগে আসতেন কিছু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা নাম সংকীর্তন করতেন। সেই দিনও বিশেষ পুজোর পরে ভোগ-আরতি হয়। এখনও গোবিন্দজিউর ভোগে থাকে খাস্তাকচুরি, রাধাবল্লভী, গজা, নিমকি, বালুসাই, লালমেঠাই, মতিচুর তালের বড়া ইত্যাদি।
পোস্তা রাজবাড়ির গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর জিউর বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা সুখময় রায়। বর্তমান ঠাকুরবাড়িটি ১৫০ বছর আগে তৈরি করেছিলেন রাজকুমার রায়। জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব আজও সাড়ম্বরে পালন করা হয় রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটে শ্যামসুন্দর জিউর ঠাকুরবাড়িতে। এই পরিবারের দিলীপকুমার রায় বলছিলেন, জন্মাষ্টমীর দিনে আঁতুর ঘরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মানুষ্ঠান, নাড়িকাটা ইত্যাদি হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে কংসের হাত থেকে সদ্যোজাত কৃষ্ণকে রক্ষা করতে রাখা হয় একটি ঢাল ও তরোয়াল। পুজোয় হয় বিশেষ হোম। ভোগে থাকে লুচি, ভাজা, মালপোয়া, সন্দেশ, দরবেশ, নানা ধরনের মিষ্টি। পরের দিন হয় নন্দোৎসব। সেই উপলক্ষে বিগ্রহকে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। তবে নন্দোৎসবের আর এক তাৎপর্য রাধারানির মানভঞ্জন। সকালে রাধারানিকে দোতলায় একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে শ্যামসুন্দর তাঁকে ভেট পাঠান। পরে রাধারানির মানভঞ্জনের জন্য শ্যামসুন্দরকেও দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় পরিবারের সদস্যরা একটি গান করেন যা পরিবারে প্রচলিত। পরে রাধিকার মানভঞ্জনের পরে যুগল মূর্তিকে এক সঙ্গে নীচে দালানে এনে সিংহাসনে স্থাপন করে আরতি করা হয়। এই সময়ে নিবেদন করা হয় তালের বড়া, মালপোয়া ভোগ।