—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
পুজোর এত আলো আর আনন্দের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে “পুজোর ভূত।” কলকাতার এই প্রাচীন প্রবাদটি নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করলেও, একটু গভীরে ভাবলে সত্যিই পুজোর ভূতদের চিনে ফেলা যায়। এই ভূতেরা হল পুজোর ক’টা দিনের বিবিধ রোগবালাই। তার মধ্যে আছে উৎসবের মরসুমের অনিয়মের ফাঁক গলে আমাদের জীবনে ঢুকে পড়া জ্বরজারি, জল বা পতঙ্গবাহিত অসুখবিসুখ, হুল্লোড়ের অসতর্কতায় হঠাৎ বিগড়ে যাওয়া স্বাস্থ্য বা আকস্মিক দুর্ঘটনা। বসন্তের মতো ভাদ্র-আশ্বিনেও এক কালে গ্রামবাংলায় কান্নার রোল উঠত, তাই তো ‘রক্তবীজবিনাশিনী’কে আবাহন করে তাঁর কাছে ‘হর ক্লেশং হর শোকং হরাশুভম্...’ প্রার্থনা রাখাও এই অকালবোধনের অন্যতম উদ্দেশ্য। অতএব, পুজোর সাজ, ভোজ যেমন চলছে চলুক। তার সঙ্গে এই সব ভূত, থুড়ি রোগবিপদগুলিকে তাড়ানোর প্রস্তুতিও নিয়ে রাখুন। এই সব ঋতুবদলের অসুখ, হঠাৎ তেড়ে আসা বা বেড়ে যাওয়া রোগবালাইয়ের কারণগুলিকে চিনিয়ে তাদের এড়িয়ে চলার পরিকল্পনা ছকে দিলেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল।
জ্বরাসুর বধ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জ্বর হয় কোনও সংক্রমণের জন্য। ধরে নেওয়া হয়, পার্লারে নানা ট্রিটমেন্ট, বাড়িতে এক ঘণ্টা ধরে শ্যাম্পু করতে গিয়ে কিংবা কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়ে ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। কিংবা হুটোপুটি করে ঘাম বসেছে। তার থেকে জ্বর এসেছে। ডা. মণ্ডল বললেন, “ঠান্ডা লাগা মানে কিন্তু শীত করা নয়। আপার বা লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে ইনফেকশনকেই চলতি ভাষায় ঠান্ডা লাগা বলে। যে সব রোগজীবাণু এই ধরনের সংক্রমণের জন্য দায়ী, এই ঋতুবদলের সময় তাদের বংশবৃদ্ধি হয়। সে কারণেই এ সময় কমন কোল্ড, ফ্লু, গলা ব্যথা বেশি হয়। ব্রঙ্কাইটিসও হতে পারে। মানুষ থেকে মানুষে এই সব ভাইরাস ছড়ায়। পুজোর ভিড়ে, আত্মীয় সমাগমের মধ্যে গেলে এই ধরনের সংক্রমণ হতেই পারে।”
মাল্টিভিটামিনে ভরা পুষ্টিকর খাবার, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লেবু জাতীয় ফল, পর্যাপ্ত জলপান করলে এই ধরনের সংক্রমণ আটকানো যেতে পারে। কোমর্বিডিটি আছে, সিওপিডি-তে ভুগছেন এমন বয়স্ক মানুষদের ফ্লু, নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দিয়ে রাখলে অনেকটা সুরক্ষিত থাকবেন। মাস্ক পরে ঘোরা শক্ত। তার বদলে সুযোগ পেলেই হাত ধুয়ে নিন, তার পর নাকের ভিতরটা ভাল করে পরিষ্কার করে রাখুন। এতে কিছুটা ভাইরাস বেরিয়ে যাবে।
মশাবাহিত রোগে...
ম্যালেরিয়া-টাইফয়েড হলেও ডেঙ্গির প্রকোপই এ সময় বেশি। ডা. মণ্ডল বলছেন, “এতে কোনও কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে দুষে লাভ নেই। আসল দোষ হল মশার। ডেঙ্গির মশা খুব চঞ্চল। এর স্বভাব হল ‘বুফে-তে খাওয়া’র। ঘরে দশ জন থাকলে দশ জনকেই কামড়াবে। অতএব, পুজোর ভিড়ের মধ্যে ডেঙ্গি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভিড়ে ঠাকুর দেখলে, অঞ্জলি দেওয়ার লাইনে বড় হাতা জামা, ভাল করে শরীর ঢাকা পোশাক পরুন। ডেঙ্গি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ চলবে, বিশ্রাম নিতে হবে। তা ছাড়া, রোগীর কার্বনেটেড ড্রিঙ্ক বা প্রিজ়ারভেটিভ দেওয়া ফলের রস খাওয়া চলবে না। বদলে ডালের জল, ডাবের জল, তাজা ফলের রস পান করা যেতে পারে।” রোগী প্রথম তিন-চার দিন আলাদা থাকলে তাঁর থেকে কিন্তু ডেঙ্গি আর ছড়াবে না। মশারি টাঙানোও ভীষণ প্রয়োজন।
পথের প্রান্তের রঙিন পানীয়
ঠাকুর দেখতে বার হলে ঘাম হবে, হাঁটাহাঁটির জন্য শ্বাসপ্রশ্বাসের হার দ্রুত হবে। তাতেও শরীরে জলের প্রয়োজন বাড়বে। তাই কিছু সময় অন্তর জল পান করুন। শরীরে জলের মাত্রা ঠিক থাকলে প্রতিমা দেখে বাড়ি ফিরে পায়ের ব্যথার সমস্যাও কম হবে। তা বলে ফ্রিজের জল বা রাস্তার ধারের বরফঠান্ডা পানীয় সরাসরি গলায় ঢাললে চলবে না। তাতে ফ্যারেঞ্জাইটিস, ল্যারেঞ্জাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। স্ট্র ব্যবহার করলে ওই পানীয় প্রথমে মুখের তাপমাত্রায় মিশবে, ফলে সংক্রমণের ভয় থাকবে না।
অসুখ থাকলে কি উৎসবে মাততে নেই?
এ সময়ে খাওয়াদাওয়ার ভোল পাল্টে যায়। সুগার, প্রেশার, কিডনির অসুখ, হার্টের রোগ থাকলে এমন বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে সমস্যাগুলো বেড়ে যেতে পারে। মাত্রাজ্ঞান রেখে খাওয়াদাওয়া করুন। নিয়মিত বাড়িতে সুগার পরীক্ষা করুন। এতে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। যে সব ফ্যাট ঘরের তাপমাত্রায় জমে যায়, সেগুলো স্যাচুরেটেড ফ্যাট। হার্টের রোগীর পক্ষে তা অপকারী। তাই বিজয়া দশমীর দিনে যতই নারকেল কুরিয়ে তৈরি করা নাড়ু লোভ দেখাক, বাড়ির লোকের কথা শুনে একটু সংযমে থাকুন। বদলে শুকনো কেক, ছানার মিষ্টি খেতে পারেন। কিডনির অসুখে প্রোটিন ঠাসা খাবার খাওয়া যায় না। তাই, রোগী নবমীর দিন দু’-এক টুকরো মাংস চাখলে কিছু হবে না, কিন্তু এক জামবাটি মাংসের স্বাদ নিতে চাইলে তাঁকে নিরস্ত করুন। মধুমেহ রোগীরা একটা করে রসগোল্লা খেলে ক্ষতি নেই। বরং চারটে বিস্কিটের চেয়ে একটা রসগোল্লা তাঁদের জন্য বেশি উপকারী। পরিমিত সরষের তেলে রান্না করা খাবার খান। বাড়তি খাওয়াদাওয়ার জন্য কোলেস্টেরল বাড়ল কিনা, পুজো শেষে এক বার মেপে দেখা ভাল।
“অসুস্থ মানুষ দুটো লুচি খেলে কোনও ক্ষতি হবে না। তবে, প্রথম দিকের ভাজা লুচি বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষকে দেবেন। কারণ তেল যত বেশি পুড়বে তা ততই খারাপ স্নেহ পদার্থে রূপান্তরিত হবে। একেই কাটা তেল বলা হয়। বাড়িতে হোক বা বাইরে, কাটা তেলে তৈরি খাবার পরিহার করুন।”
হঠাৎ বিপদের মোকাবিলা
স্থানীয় নার্সিংহোম, অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর হাতের কাছে রাখুন। কোনও সমস্যায় পড়লে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যাবে। আর, গ্যাসের ব্যথা মনে করে বুকের ব্যথাকে অবহেলা করবেন না। বুকে ব্যথা, চাপ লাগছে মনে হলে নাইট্রেট জাতীয় ওষুধটি জিভের তলায় দেবেন না। এটি বিপজ্জনক ও অবৈজ্ঞানিক। ডা. মণ্ডল বললেন, “এ সময় দুটি ওষুধ দেওয়া উচিত। কোলেস্টেরল মাত্রায় রাখতে যে ওষুধটি খাচ্ছেন, সেটি প্রেসক্রাইবড ডোজ়ের চার গুণ বেশি খেতে হবে। আর রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ চট করে একটা খেয়ে নেবেন।”
বয়স যাই হোক, স্বাস্থ্য যেমনই হোক পুজোর মধ্যে শরীরে যে কোনও অসুবিধে বোধ হলেই বাড়িতে জানান। পুজোর সময় মাইকে গান শুনতে ভাল লাগলেও অনেক ক্ষণ নাগাড়ে মাইক বাজলে মস্তিষ্ক বরদাস্ত করতে পারে না। কানে তালা লেগে যাওয়ার সমস্যা থাকলে যেখানে সজোরে মাইক বাজছে, সেই জায়গা থেকে সরে আসাই বিচক্ষণতা। তবে দেখা গিয়েছে, শিশু, বয়স্কদের তুলনায় মধ্যবয়সিরাই মাইকের তীব্র শব্দে বেশি অস্বস্তি বোধ করেন। সহ্যসীমার মধ্যে এবং মানুষের বিশ্রামের সময় বাদ দিয়ে মাইক ব্যবহার করলে সকলেই পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।
চিকিৎসকের এই লক্ষণরেখায় একটু খেয়াল রেখে উৎসবে শামিল হোন। তা হলেই ‘পুজোর ভূত’ আপনার ঘরে ঢুকে উপদ্রব করতে একটুও সাহস পাবে না। আর বাইরেই বা বেশি ক্ষণ টিকবে কী ভাবে? সেখানে তো আকাশবাতাস ভরে আছে পবিত্র গন্ধে আর অমৃতের শব্দে— রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।