Fall Prevention

শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন প্রণববাবুও, বয়স বাড়লেই কি বাড়ে ঝুঁকি?

বেশি বয়সে আচমকা পতনও তার ফলে মৃত্যু (পরিভাষায় ‘ফ্যাটাল ফল’) নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পরিসংখ্যান  জানলে চমক লাগবে।

Advertisement

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রোশনি কুহু চক্রবর্তী      

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:২৬
Share:

প্রণব মুখোপাধ্যায় ও যশোবন্ত সিংহ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই বয়সজনিত কারণে পড়ে গিয়েছিলেন।

বয়সজনিত কারণে শৌচাগারে পড়ে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি কি বাড়ছে? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

Advertisement

শৌচাগারে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন অশীতিপর প্রণব মুখোপাধ্যায়। মস্তিষ্কে জরুরি অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণেও ভুগছেন তিনি। নয়াদিল্লির সেনা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন যুঝেও ফিরতে পারেননি দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, সংসদে প্রণববাবুর প্রাক্তন সহকর্মী যশোবন্ত সিংহও শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই পতনজনিত কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে স্নায়বিক জটিলতা তৈরি হয় তাঁর শরীরে। সেটা ২০১৪ সালের অগস্টের ঘটনা। এখনও কোমাতেই আচ্ছন্ন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।

বেশি বয়সে আচমকা পতনও তার ফলে মৃত্যু (পরিভাষায় ‘ফ্যাটাল ফল’) নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পরিসংখ্যান জানলে চমক লাগবে। প্রতি বছর বিশ্বের কত লক্ষ কোটি মানুষ আচমকা পড়ে যান, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনও না থাকলেও হু-র তথ্য বলছে, আচম্বিতে ভূপতিত মানুষের মধ্যে ৪ কোটির কাছাকাছি গুরুতর চোট পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁদের সিংহভাগই ৬৫-উত্তীর্ণ। এঁদের মধ্যে ৬ লক্ষ ৪৬,০০০ জন স্রেফ পড়ে যাওয়ার কারণেই প্রাণ হারান।

Advertisement

আরও পড়ুন:বিখ্যাত মানুষের আত্মহত্যার খবরে কি মানুষ আরও বিপন্ন বোধ করেন? কী বলছেন মনোবিদরা​

মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসের কথায়, ‘‘বয়সকালে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে অনেকে পড়ে যান। অনেককে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ নিয়মিত খেতে হয়। ফলে ঘুম ভাঙার পরেও একটা ঝিমুনি ভাব থাকতে পারে। সেই থেকে এমন পতন হতে পারে। দেহের ভারসাম্য রক্ষার তিনটি অস্ত্র হল চোখ, কান এবং মস্তিষ্ক। এর কোনও একটিতে ব্যাঘাত ঘটলেই পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। হৃদরোগের সমস্যা থাকলেও সাবধানে থাকতে হবে প্রবীণদের।

বয়স্ক মানুষরা হাঁটাচলার সময় সাবধানে থাকতে হবে। ফাইল ছবি।

হৃদরোগের জন্য রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলে সিনকোপের কারণে এমন হতে পারে বলেও অভিমত অরিন্দমের। তিনি বলেন, ‘‘ভার্টিগোর সমস্যা, সুগারের ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়া, ভিটামিনের অভাব— এই প্রতিটি বিষয়ে খেয়াল রাখতেই হবে। নিয়মিত পরীক্ষাও করাতে হবে।’’

আরও পড়ুন:আক্রান্তের সিংহভাগই মহিলা, মাইগ্রেনের সমস্যা সমাধানে এগুলি মাথায় রাখতেই হবে​

হু-র অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, পড়ে-যাওয়া মানুষদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে গৃহবন্দি হতে বাধ্য হন। সেই তালিকার শীর্ষে আমেরিকা। সেখানে প্রতি ১১ সেকেন্ডে ১ জন ৬৫ উত্তীর্ণ মানুষ পড়ে গিয়ে হাসপাতালে যান। প্রতি ১৯ মিনিটে ১ জন পতনজনিত কারণে চোট পেয়ে মারা যান। ভারতের ক্ষেত্রে এমন কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি পরিবারের বয়স্ক মানুষদের প্রধান সমস্যাই হল পড়ে গিয়ে শয্যাশায়ী হওয়া।

বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ (পরিভাষায় ‘জেরিয়াট্রিশিয়ান’) কৌশিক মজুমদারের কথায়, ‘‘প্রণববাবুর মতো সিনিয়র সিটিজেনদের পড়ে যাওয়ার পিছনে মূলত দু’টি কারণ থাকে। প্রথমত, এক্সট্রিনসিক ফ্যাক্টর অর্থাৎ বাহ্যিক কারণ। পিচ্ছিল মেঝে, এবড়োখেবড়ো রাস্তা, চটি বা জুতো ছিঁড়ে যাওয়া বা হড়কে পড়ে যাওয়া। বা কোনও দড়ি অথবা কোনাচে কিছুতে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া। শাড়ি, ধুতি বা পোশাকে পা জড়িয়ে, সিঁড়ি, টুল বা কোনও উঁচু জায়গায় উঠতে-নামতে গিয়েও পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।’’কৌশিকের মতে, ‘‘দ্বিতীয় কারণ ইন্ট্রিনসিক ফল। অর্থাৎ কোনও শারীরিক অসুস্থতা বা অপারগতার কারণে পড়ে যাওয়া। বয়স বাড়লে দৃষ্টিশক্তি অস্বচ্ছ হয়ে যায়। পাশাপাশি এবং ও রাতের দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। শ্রবণশক্তি কমে গেলেও আচমকা কানের পাশে জোর শব্দ শুনে চমকে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।’’

বয়সের কারণে গতিবিধি ও ক্ষিপ্রতা শ্লথ হয়ে যাওয়ায় কোনও অনভিপ্রেত ঘটনায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থেকেই যায়। এ ছাড়া বেশি বয়সের কারণে কিছু দীর্ঘস্থায়ী অসুখও থাকতেপারে। অসুখের কারণে দুর্বলতা ও ভারসাম্যের অভাবে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। হৃদরোগের কারণে সংজ্ঞা হারালে চেতনা ফেরার পর আপাতদৃষ্টিতে অনেককেই দেখে সুস্থ মনে হয়। হৃদযন্ত্রের কারণেই অজ্ঞান হওয়া কিনা, তা পরীক্ষা করা জরুরি। প্রয়োজনে পেসমেকার বসাতে হতে পারে। স্নায়ুর সমস্যা থেকে আচমকা জ্ঞান হারালে অনেক সময় সংজ্ঞা ফেরার পর কথা জড়িয়ে যেতে পারে। এই বিষয়গুলি খেয়াল রাখতেই হবে বলে মনে করছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবব্রত রায়।

নাক-কান-গলার রোগের বিশেষজ্ঞ অর্জুন দাশগুপ্তের বক্তব্য, ‘‘মানুষের ভারসাম্যের মূল জায়গাটা কানে। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি অর্থাৎ চোখ, তারপর হাঁটু (কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন। এবড়োখেবড়ো পৃষ্ঠ নাকি সমতল)। এ ছাড়াও মেরুদণ্ডের মাধ্যমে তথ্য পৌঁছয় মস্তিষ্কে। তাই সবটাই জরুরি। বয়স বাড়লে আস্তে আস্তে প্রতিটি অঙ্গেরই কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। তাই পড়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। তবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার বিষয়টা আলাদা।’’

আরও পড়ুন:

কোন কোন রোগে এমন আচমকা পতনের ঝুঁকি রয়েছে? বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা জানাচ্ছেন, পার্কিনসন্স, অ্যালঝাইমার্স, অস্টিওপোরোসিস, স্ট্রোক, ক্যানসার, অবসাদ, আচমকা রক্তচাপ কমে বা বেড়ে যাওয়া, অস্থিসন্ধি নড়াচড়ায় অসুবিধা, আংশিক পক্ষাঘাত ও হাত পা কাঁপা, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওই ঝুঁকি বাড়ে। কৌশিকের কথায়, ‘‘কোনও বয়স্ক মানুষের জ্বর হলে শৌচাগারে যেতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারেন। আবার হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হলেও পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেকে বারে বারে পড়ে যান। হার্ট ব্লক থাকলে বা টিআইএ জাতীয় ছোট ছোট স্ট্রোক হলে একাধিকবার পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।’’

হার্ট ব্লক থাকলে একাধিকবার পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ফাইল ছবি।

বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে য়ে বিষয়গুলিতে নজর দিতে হবে—

১। পোশাকের ঝুল যেন মাপসই হয়। পায়ে আটকে হোঁচট খেতে না হয়। চটি বা জুতোর তলায় যেন গ্রিপ থাকে। শৌচাগার ও ঘরের দূরত্ব কম রাখা। মেঝেতে জল পড়ে যেন পিছল না হয়। বাড়ির প্রতিটি ঘরে যেন পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকে।

২। নার্ভের অসুখ, হার্টের অসুখ, প্রেশার, সুগার-সহ অন্য অসুখ থাকলে তার যথাযথ চিকিৎসা। হিয়ারিং এড এবং চশমার পাওয়ার ঠিক রাখা।

৩। ‘হোম অ্যাডাপ্টেশন’ অর্থাৎ ঘরের মধ্যে বয়স্কদের হাঁটাচলার সুবিধার জন্য দরকার মতো রেলিং। শৌচাগারে প্রবেশের পথেও তেমনই কোনও ব্যবস্থা রাখা।

৪। নিয়ম করে কিছু শরীরচর্চা করা। যাতে হাত, ঘাড়, শিরদাঁড়ার পেশির স্থিতিশীলতা বাড়ে।

৫। নিয়ম করে আধ ঘণ্টা যোগাসন, প্রাণায়াম ও হাঁটাচলা করা। মন ভাল রাখা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement