দক্ষিণ ভারতীয় রান্নার বিশেষত্বই নারকেলে তেল। ছবি: পিক্সঅ্যাবে।
বৃহস্পতিবার দিনভর নারকেল তেলে সন্দিহান হয়ে সোশ্যাল সাইটে নানা সূত্র খুঁজে বেড়াল স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। কেউ বা নিছকই কৌতূহলে। সৌজন্যে কারিন মিচেলসের একটি বক্তব্য।
হার্ভার্ডের ‘টি এইচ চান স্কুল অব পাবলিক হেলথ’-এর অধ্যাপক কারিন মিচেলস। এমনিতে মার্কিন মুলুকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এই অধ্যাপকের বেশ খ্যাতি আছে। ইউনিভার্সিটি অব ফ্রেইবার্গের সঙ্গেও যুক্ত তিনি। সেই তিনিই কি না নারকেল তেলকে ‘বিশুদ্ধ বিষ’ বলে দেগে দিলেন এক সেমিনারে! বৃহস্পতিবার সেই সেমিনারের ভিডিয়ো ইউটিউবে আপলোড হতেই শুরু হয়েছে আলোচনা। সেই ভিডিয়ো সোস্যাল সাইটে শেয়ার হল ভুরিভুরি। ভিউয়ার সংখ্যা ছাড়াল দশ লক্ষ।
সেমিনারে এ দিন নারকেল তেল ও অন্যান্য তার পুষ্টিগত ত্রুটি নিয়ে নিজের বক্তব্য রাখেন কারিন। তাঁর মতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারকেল তেলকে খুব স্বাস্থ্যকর উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও তা আদতে তেমন কিছু নয়। একে আমেরিকাতেও ‘সুপার ফুড’ বলেনঅনেকে। কিন্তু কারিন নির্দিষ্ট করেছেন, এর কিছু ক্ষতিকারক দিকের কথা। আর তা এতই নাকি ক্ষতিকর যে, তাকে ‘বিশুদ্ধ বিষ’ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। নারকেল তেলে রান্নার প্রচলন কেবল এ দেশে নয়, বিদেশের নানা স্থানেও বেশ চালু। কিন্তু কারিন সচেতন করে জানান, সব চেয়ে কুখাদ্যের মধ্যে অন্যতম এই নারকেল তেল!
আরও পড়ুন: ডিমের খোসা ফেলে দেন? এ সব জানলে আর ফেলবেন না
কিন্তু কেন এমন দাবি করছেন এই অধ্যাপক? তাঁর মতে, নারকেল তেলের ৮০ শতাংশই ভর্তি স্যাচুরেটেড ফ্যাটে।যে পরিমাণ কি না রেড মিট বা মাখনের চেয়েও বেশি। তাই এর প্রভাবে কোলেস্টেরল, হৃদযন্ত্রের অসুখ, ওবেসিটি কিছুই অসম্ভব নয়। শরীরে লাইপোপ্রোটিন কমিয়ে দিতেও তা সক্ষম।
বিতর্ক-পাল্টা বিতর্কের জোয়ার শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকেই। এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ নিউট্রিশন ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, খাদ্যতালিকায় থাকতেই পারে নারকেল তেল। তবে তা নামমাত্র। কারণ এর স্যাচুরেটেড ফ্যাট নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে ‘বিষ’ ঠিক একে বলা যায় না। এ দিকে কারিনকে পূর্ণ সমর্থন করেছে ‘আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’। তাদের দাবি, ভারতে এই নারকেল তেলের রান্না এত জনপ্রিয় বলেই এ সব দেশে হৃদযন্ত্রের সমস্যা ওবেসিটি ও মৃত্যুর হার এত বেশি।
নারকেল তেলে রয়েছে ৮০ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট। ছবি: শাটারস্টক।
আবার ‘আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিকাল নিউট্রিশন’-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, হাই স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড-ই যে কেবল নানা অসুখবিসুখ বাধিয়ে মৃত্যুর দিকে মানুষকে ঠেলে দেয় এমনটা নয়। বরং, স্যাচুরেটেড ফ্যাটের চেয়েও ক্ষতিকারক নন স্যাচুরেটেড ফ্যাট, আর সে সবও কম-বেশি আমাদের খাদ্যতালিকায় থাকেই। এমনকি, ভাতের মধ্যেও রয়েছে খুব সহজে দ্রবীভূত হয় না এমন ফ্যাট, তাই ভাত থেকে জন্মানো গ্লাইকোজেন গলতেও অনেক সময় লাগে।
আমেরিকার আর এক মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানকেট’ সম্প্রতি ১৮টি দেশের ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষকে নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। এদের মধ্যে কেউ খুব বেশি ফ্যাট জাতীয় খাবার খেতেন, আবার কেউ লো-ফ্যাট ডায়েটে অভ্যস্ত ছিলেন।সেখানে দেখা যায়, লো ফ্যাট ডায়াটের মানুষরাই তুলনায় হৃদযন্ত্রজনিত অসুখে বেশি ভুগছেন! তাদের মতে, কেবল খাওয়াদাওয়াই নয়, হার্টের অসুখের থাকে আরও নানা কারণ। তাই এর এতটা সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। কে কী খাচ্ছেন, কী ধরনের ফ্যাট খাচ্ছেন— এ সবের উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।
আরও পড়ুন: আপনার এ সব ভুলের জন্যই সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ছে না তো?
কী বলছেন এ রাজ্যের চিকিৎসকরা? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী একেবারেই মেনে নিচ্ছেন না কারিনের বক্তব্য। তাঁর মতে, দক্ষিণ বারতে হাজার হাজার বছর ধরে নারকেল তেলের রান্না প্রচলিত। সেখানে মানুষের বিজ্ঞানবোধও কম নয়। সে তো এক প্রকার বলতে গেলে অতিরিক্ত তেলই শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। তার জন্য নারকেল তেলকে আক্রমণের কোনও কারণ নেই। বরং নন স্যাচুরেটেড ফ্যাট স্যাচুরেটেড ফ্যাটের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে।
তাঁর সুরেই কথা বলছেন গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট ভাস্করবিকাশ পাল। তাঁর মতে, বিদেশে কী ভাবে নারকেল তেল ক্যানবন্দি হচ্ছে, ঠিক কোন পদ্ধতিতে তারা তা সংরক্ষণ করে এ সবের উপরও তার গুণাগুণ নির্ভর করে। তা ছাড়া ভারতের আবহাওয়া ও বিদেশের আবহাওয়াও এক নয়। এ দেশে যা খেলে নিরাপদ, ও দেশে তা-ই বিপদের। আবার উল্টোটাও সত্যি। তাই এ দেশে এখনই নারকেল তেল নিয়ে অযথা ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তবে তেল বেশি খাওয়া কোনও অবস্থাতেই ঠিক নয়। তাই বর্জন করুন অতিরিক্ত তেলের রান্না। কেবল নারকেল তেলকে ‘একা ভিলেন’ ঠাউরানোর কারণ এখনই নেই।