জন্মগত কারণ বা অনিয়মিত জীবনধারা প্রভাব ফেলতে পারে বাচ্চাদের হৃদ্যন্ত্রের উপরে। প্রতীকী ছবি।
সকাল থেকে স্কুল, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সারাদিন দম ফেলার সুযোগ পায় না ষষ্ঠ শ্রেণির ঋতম। তাই দিনের শেষে মোবাইলে কিছু ভিডিয়ো গেম খেলতে চাইলে বাধা দেন না মা কাকলি। ছুটির দিনে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলতে গেলেও হাঁপিয়ে ওঠে ঋতম, বলে, ‘বুকে ব্যথা’। উদ্বিগ্ন কাকলি এক দিন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গিয়ে দেখেন, ছেলে হৃদ্রোগের শিকার।বাচ্চাদের হৃদ্রোগের বিষয়ে উদাসীনতা দেখা যায় অনেক অভিভাবকের মধ্যেই। তবে শিশুদের মধ্যে জন্মগত ভাবে বা জন্মের পরে দেখা দিতে পারে হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা। অনেক সময়ে আবার অনিয়মিত জীবনযাপনও ডেকে আনে হৃদ্রোগ।
জন্মগত বা জন্মের পরে
জন্মগত ভাবে হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা অর্থাৎ কনজেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ় হলে হৃদ্যন্ত্রটি আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছোট বা বড় হতে পারে। পরিশোধিত রক্ত সঞ্চালন ঠিকঠাক ভাবে না হওয়া বা হৃদ্যন্ত্রে ছিদ্র থাকার মতো সমস্যা হতে পারে। পাশাপাশি, পালমোনারি ভালভ স্টেনোসিস নামে সমস্যাটিও দেখা দিতে পারে।এ ছাড়া, কাওয়াসাকি হার্ট ডিজ়িজ়, হৃদ্যন্ত্রে টিউমর হওয়া, পেটেন্ট ডাক্টাস আর্টেরিওসাস (পিডিএ) কিংবা হার্টব্লকও দেখা যায়। এই রোগগুলি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই (২-১৫ বছরের মধ্যে) বেশি প্রকট হয়।পাশাপাশি, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ সুনীলবরণ রায় জানাচ্ছেন, জন্মগত ভাবে হৃদ্যন্ত্রের ত্রুটির ক্ষেত্রে ‘ব্লু বেবি’- এই উপসর্গ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ‘ব্লু বেবিদের’ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হাত, নখ, জিভ ও শরীরের নানা অঙ্গে নীলচে ভাব ফুটে ওঠে। সঙ্গে থাকে শ্বাসকষ্ট। তখন হার্টের সমস্যা নির্ধারিত না হলেও যদি জন্মের পর থেকে বারবার হাঁপিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন জ্বর, শ্বাসকষ্ট হওয়া, বুকে, গাঁটে, পায়ে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়, তা হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
কেন সমস্যা
জন্মগত ভাবে হার্টের সমস্যার নেপথ্যে কোনও নির্দিষ্ট কারণ এখনও দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছেন পেডিয়াট্রিক সার্জন প্রফুল্লকুমার মিশ্র। মাঝেমাঝে আবার হৃদ্যন্ত্রে ত্রুটি থাকলেও তা জন্মের সময় ধরা না-ও পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে জন্মের কিছু সময় পর থেকে হৃদ্যন্ত্রে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা। নির্দিষ্ট কারণ বলা না গেলেও, গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতার অভাব এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ সুনীলবরণ রায় ও চিকিৎসক প্রফুল্লকুমার মিশ্র জানাচ্ছেন,
গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তাল্পতা থাকলে তা পরে প্রভাব ফেলতে পারে শিশুর হৃদ্যন্ত্রের উপরে।
শিশুর কিডনি কাজ না করার ফলে শরীরে জল জমলেও তার প্রভাব পড়ে হৃদ্যন্ত্রে।
অনেক সময়ে গর্ভাবস্থায় মায়ের বা পরে শিশুর টনসিলাইটিস থেকে সংক্রমণ ছড়ালে বা আশপাশে পরিচ্ছন্নতার অভাবে নানা ধরনের সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এর ফলে ‘রিউম্যাটিক ফিভার’ হতে পারে। রিউম্যাটিক ফিভারের ক্ষেত্রেও দেখা যায় জ্বর, গাঁটে ব্যথার মতো সমস্যা।
জীবনধারার প্রভাব
হার্টের সমস্যা বাচ্চার জীবনধারার জন্যও হতে পারে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন:
এখন শিশুদের মধ্যে খেলাধুলোর প্রবণতা কমে গিয়েছে। বড় বাড়ি, সবুজ মাঠের জায়গায় ফ্ল্যাটই এখন বেশি। ফলে সারাদিন একই জায়গায় বসে পড়াশোনা করা বা গ্যাজেটের মাধ্যমেই নিজের বিনোদনকে বেছে নিতে প্রায় বাধ্যই হচ্ছে বাচ্চারা।
অতিরিক্ত তৈলাক্ত, ক্যালোরি বা লিপিডযুক্ত খাবার বাচ্চারা বা তাদের অভিভাবকেরাও বেছে নেন প্রায়ই। দীর্ঘদিন এই অনিয়ম চললে স্থূলতা বাড়ে। কম বয়সেই তাই দেখা দিতে শুরু করে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার সমস্যা।
মা-বাবার হাইপারটেনশন থাকলে সন্তানেরও কম বয়স থেকেই তা দেখা দিতে পারে।
বাচ্চারা ধূমপান না করলেও অনেক সময়ে তারা ‘প্যাসিভ স্মোকার’ হয়ে ওঠে। কিছু ক্ষেত্রে, কৈশোর থেকেই তারা মদ্যপান বা ধূমপানের অভ্যেস করে। এরও প্রভাব পড়ে তাদের হার্টের উপরে।
রয়েছে উপায়
বাচ্চাদের হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা দেখা দিলে অভিভাবকেরা যেমন প্রথমে তা মানতে চান না, তেমনই কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চিন্তা করে ফেলেন। চিকিৎসকেদের পরামর্শ,
জন্মগত ভাবে হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা দেখা দিলে বেশির ভাগ সময়ে অস্ত্রোপচারের সাহায্যে তা ঠিক করা যেতে পারে। জন্মের কিছু সময় পরে যদি হার্টের ত্রুটি দেখা দেয়, তা হলেও অস্ত্রোপচার বা ওষুধ কাজে দেয়। এই দুই ক্ষেত্রে, চিকিৎসার পরে বাচ্চা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
অনিয়মিত ক্যালরি ও লিপিড যুক্ত খাবার খাওয়া বা শারীরচর্চার দিকে নজর না দেওয়া কাম্য নয়। স্থূলতা যাতে কম বয়সে গ্রাস না করে, সে দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বাচ্চাদের সামনে বড়দের ধূমপান, কৈশোরে ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থেকে বিরত থাকা দরকার।
রোজকার খাদ্যতালিকায় ফাইবারযুক্ত খাবার যেমন সবুজ আনাজ, মুসুরির ডাল, ফল খাওয়ার অভ্যেস করাতে হবে বাচ্চাদের।
রোজ বাচ্চারা অন্তত আধ ঘণ্টা শারীরচর্চা করলেও লাভ হবে। সঙ্গে কমাতে হবে স্ক্রিন টাইম।