ডিসেম্বর মাস পড়ে গিয়েছে। সন্ধ্যে বাড়লেই গায়ে লাগছে হিমেল হাওয়ার পরশ। ঠাণ্ডা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শ্বাসকষ্টের সমস্যাও। বিশেষত কোভিড পরবর্তী সময়ে দৈনিক জীবনযাপনের কারণেই হোক কিংবা শারীরিক সমস্যার জন্য, আধুনিক সমাজে ঘরে ঘরে চোখে পড়ছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। শ্বাসকষ্টের মূল কারণ ঠিক কী? পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে কি এই রোগের কোনও যোগ রয়েছে? জিনগত কারণে কি এই রোগ হতে পারে? কোন কোন বিষয়ে মানুষের সাবধান হওয়া প্রয়োজন? কী করলে এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচবেন? — ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললেন আমরি হসপিটালের চিকিৎসক তথা সিনিয়র পালমোনোলজিস্ট অংশুমান মুখোপাধ্যায়।
সাধারণভাবে আমরা দেখেছি শীতকাল বাড়লেই শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে? তাপমাত্রার সঙ্গে শ্বাসকষ্টের কি কোনও সম্পর্ক রয়েছে?
আমরা সাধারণভাবে দেখি ধুমপানের কারণে বা অন্য কোনও রোগের কারণে শ্বাসকষ্টে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই শীতকালের প্রতি একটি ভীতি থাকে। এবং অবশ্যই এই ভীতি আসে অসুখ বেড়ে যাওয়ার জন্য। এই প্রধান কারণ হল শীতকালে আবহাওয়া বদলে যায়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমতে থাকে। পাশাপাশি বাড়ে ধুলোর পরিমাণ। এই সময়ে কুয়াশা বা ধোঁয়াশা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ অনেক বেশি পরিমণে এই ধুলিকণা নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে। সেই সঙ্গে আর্দ্রতা কমার কারণে শুকনো বাতাসে শ্বাসক্রিয়া চলতে থাকে। এই দুই কারণেই শীত বাড়লেই শ্বাসকষ্ট বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও কালিপুজোতে বা দিপাবলীর সময় যে বাজি পোড়ানো হয়, সেই বাজির ধোঁয়া থেকেও অনেক সময় শ্বাসকষ্ট হতে পারে। মনে রাখতে হবে, দুর্গা পুজোর পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ শীতের শুরুতে কিন্তু ফ্লু জাতীয় রোগের প্রকোপ বাড়ে। এই রোগও কিন্তু শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে।
শ্বাসকষ্ট কী জিনগত রোগ? এর কোনও ব্যাখ্যা রয়েছে কী?
প্রথমেই বুঝতে হবে, শ্বাসকষ্ট কিন্তু অসুখ নয়, অসুখের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই অসুখগুলির মধ্যে প্রথমেই আসে অ্যাজমা। কিছু ক্ষেত্রে অ্যাজমার সঙ্গে জিনগত যোগ থাকতে পারে। কিন্তু এই সংখ্যাটা মাত্র ১৫-২০ শতাংশ। এবং যে বাচ্চাদের অ্যাজমা থাকে, সেগুলি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও রোগের কারণে হতে পারে। যেমন ব্রঙ্কাইটিস, বুকে কফ জমে যাওয়া, ফ্লু ইত্যাদি। পাঁচ বছর পরেও যদি বাচ্চার অ্যাজমা থাকে এবং সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে, তা হলে সত্যিই চিন্তার কারণ রয়েছে। যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করা যায়, তা হলে সহজেই এই রোগ থেকে মুক্তি মেলে।
কোভিড পরবর্তী সময়ে রোগীদের শ্বাসকষ্ট বাড়েছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে রোগীরা মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এর কারণ কী? এর সমাধানও বা কী?
কোভিড আমাদের প্রত্যেকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। কোভিডের পরবর্তী সময়ে রোগীদের ফুসফুস শুকিয়ে যাওয়া, লাংস হাইড্রোসিস, ফুসফুসের ক্ষতি ইত্যাদি নিয়ে বার বার আলোচনা হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা প্যানিক বা আতঙ্কে ভুগছেন। যে সমস্ত রোগীর হালকা কোভিড হয়েছে, এমনকী অক্সিজেনও লাগেনি, বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাঁরাও কিন্তু আতঙ্কের কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে ভাবছেন। ফলে এই শ্বাসকষ্টের নেপথ্যে আসল রোগের ভিত্তি আদৌ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। প্রয়োজনে বার বার এক্স রে, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি বিভিন্ন পরীক্ষা করতে হবে। আবার অনেক রোগী তীব্র কোভিডে ভুগেছেন। তাঁদের ফুসফুসের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা সেরে উঠতে কিন্তু বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। সেটা ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। মনে রাখতে হবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সেরে ওঠা সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক হয়ে যাচ্ছে। কোনও রকম চিকিৎসা ছাড়াই। এই নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
শ্বাসকষ্ট কী কোনওভাবে লাইফস্টাইল রোগের মধ্যে পড়ে?
কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই হ্যাঁ। ধুমপান থেকে যে সব রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তা অবশ্যই জীবনযাপন সঙ্গে যুক্ত। অনেক ক্ষেত্রে মোটা হয়ে যাওয়ার কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সেটিও জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত। আবার পরিবেশের চারপাশে যে পরিমাণ দূষণ বাড়ছে, তা স্বভাবতই বহু মানুষের শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে। যাঁরা দূষণ যুক্ত এলাকায় কাজ করছেন অথচ, উপযুক্ত রক্ষণ নিচ্ছেন না, তাঁদেরও কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্বাসজনিত সমস্যা দেখা যেতে পারে। আবার যাঁদের বয়স ৫০-৫৫ বা ৬০ বছরের উপরে, তাঁদেরও কিন্তু বিভিন্ন কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
কী করে এই শ্বাসকষ্টের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে?
প্রথমেই বলব, জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অবিলম্বে ধুমপান বর্জন করতে হবে। প্রতিনিয়নত শরীরচর্চা করতে হবে। শ্বাসকষ্ট থাকলে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী শরীরচর্চা করুন, হাঁটাহাঁটি করুন। যদি কোনও ওষুধ চলে, তা হলে তা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বন্ধ করা চলবে না। বাড়ির বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। ধুলোবালি এড়িয়ে চলুন।
জরুরি অবস্থায় কল করুন ২৪x৭ হেল্পলাইন নম্বরে - (০৩৩) ৬৬৮০ ০০০০
এই প্রতিবেদনটি আমরি হসপিটালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।