বাবা-মায়ের সঙ্গে নেহা। — নিজস্ব চিত্র।
ফেসবুক পোস্টটা প্রথম যখন নজরে পড়েছিল, তেমন পাত্তা দেননি বহুজাতিক সংস্থার কর্মী সুমন সান্যাল। কিন্তু দিন কয়েক পরেই আবার দেখলেন সেই একই পোস্ট। এ বার তাঁর দিল্লিবাসী এক বন্ধু নিজের ওয়ালে শেয়ার করেছেন সেটি।
একটি ছোট মেয়ে বিরল অসুখে ভুগছে। তার চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। সঙ্গে একটি ফোন নম্বর এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর। এ বার আর গুরুত্ব না দিয়ে পারলেন না সুমন। সরাসরি ডায়াল করলেন নম্বরটি। বিশদে শুনলেন ছোট্ট মেয়ের গল্প। তার পর সামিল হয়ে গেলেন তার লড়াইয়ে।
লড়াইটা আসলে শুরু করেছিলেন কয়েক জন চিকিৎসক। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এগিয়ে এসেছিল সুমন সান্যালের মতো অনেকগুলো অচেনা হাত। শেষ পর্যন্ত সেই হাতগুলো ধরেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে দশ বছরের নেহা মাহাতো। বিরল এক রোগের শিকার ছিল নেহা। ঘুমোতে ভয় পেত। ঘুমোলেই যে বড় কষ্ট! দম আটকে আসত। বাবা শীতল মাহাতো বলছিলেন, একদিন হঠাৎই সামান্য সর্দি-জ্বর থেকে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল নেহা। কিছুতেই শ্বাস নিতে পারছিল না। কলকাতার ইন্সটিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মাত্রই শিশু বিশেষজ্ঞ প্রভাসপ্রসূন গিরি, অগ্নিশেখর সাহা এবং সৌমেন মেউর তাকে ভেন্টিলেশনে রাখার নির্দেশ দেন। তার পর একুশ দিন চলে যমে-মানুষে টানাটানি।
ঠিক কী হয়েছিল নেহার? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই পাঁজরের গঠনগত সমস্যা ছিল নেহার। ফলে তার ফুসফুসটি ঠিকমতো প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হতে পারত না। দীর্ঘদিন এমন হতে হতে তার শরীরে কমে আসছিল অক্সিজেনের পরিমাণ, বাড়ছিল কার্বন-ডাই-অক্সাইড। চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল ফুসফুসের ওপর। ডাক্তারি পরিভাষায় এই অবস্থাকে বলে ‘পালমোনারি হাইপারটেনশন’। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল নেহার হৃৎপিণ্ডও। এ সবের জেরে একরত্তি মেয়ের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াই ক্রমশ বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকেরা জানান, বিরল এই রোগের নাম ‘হাইপোভেন্টিলেশন সিন্ড্রোম’। এই রোগের হাত ধরে আবার ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’ও দেখা দেয় নেহার। অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে দম আটকে যাওয়া। সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা।
তিন সপ্তাহ ভেন্টিলেশনে থাকার পর খানিকটা সুস্থ হয় নেহা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্য জায়গায়। বাড়ি ফিরে ঘুমোনোর সময়ে নেহা যাতে ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে, তার জন্য দরকার ছিল ‘বাইপ্যাপ’ নামে একটি যন্ত্রের। যন্ত্রটির দাম দু’লক্ষ টাকা। এখানেই মহা ফাঁপরে পড়ে নেহার পরিবার। গরিব ব্যবসায়ী শীতলবাবু চিকিৎসকদের জানান, মেয়ের জন্য এত দামী যন্ত্র কেনা তাঁর সাধ্যের অতীত। তাঁরা যেন বিকল্প কিছু ভাবেন। কিন্তু নেহার বেঁচে থাকার জন্য ওই একটি মাত্র রাস্তাই খোলা ছিল তখন।
অগত্যা এগিয়ে আসেন নেহার ‘ডাক্তার আঙ্কল-আন্টিরা’। ঠিক করেন, নেহাকে বাঁচাতে তাঁরাই টাকা তুলবেন। তৈরি হয় তহবিল। প্রভাসবাবু, অগ্নিশেখরবাবু, সৌমেনবাবুর পাশাপাশি এগিয়ে আসেন জুনিয়র ডাক্তার অনিরুদ্ধ, রাজন, কাকলি, অভিজিৎ, রস্মিতারা। টাকা তোলার পুরো দায়িত্বই নিজের কাঁধে নেন ডাক্তার অনিরুদ্ধ ঘোষ। প্রথমে চিকিৎসকদের মধ্যেই চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু তাতে পুরো টাকা ওঠেনি। অগ্নিশেখরবাবুর কথায়, ‘‘এই সময়ে প্রভাস সিদ্ধান্ত নেয়, খবরটা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাবে। আমরাও সায় দিই ওর প্রস্তাবে।’’
ফেসবুকে নেহার কথা লিখে একটি ফোন নম্বর দেওয়া হয়। দেওয়া হয় তার বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরটিও। প্রভাসবাবু জানালেন, নেহার কথা ফেসবুকে পোস্ট করার কিছু সময় পর থেকেই সাহায্য করতে চেয়ে প্রচুর ফোন আসতে থাকে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়তে থাকে টাকা। বিন্দু বিন্দু জুড়েই সিন্ধু গড়ে ওঠে এক দিন। উঠে আসে বাইপ্যাপ কেনার খরচ। ইতিমধ্যে সাহায্য আসে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকেও।
চিকিৎসকদের কাছে কত দরিদ্র মানুষই তো আসেন। তা হলে হঠাৎ একটি শিশুর জন্য এতটা উদ্যোগী হতে গেলেন কেন? প্রভাসবাবু বলছেন, ‘‘চিকিৎসক হিসেবে আমরা তো সব রোগীকেই বাঁচিয়ে তুলতে চাই। কিন্তু পারি না। আসলে মেয়েটা এত মিষ্টি, এত বুদ্ধিমান। শুধু ক’টা টাকার জন্য ও বাঁচবে না, এটা মানতে পারিনি। আমরা সবাই বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে।’’ প্রত্যয়ী ডাক্তার যোগ করেন, ‘‘আমি উদ্যোগী না হলে অন্য কেউ হতো। কিন্তু বাঁচতে হতোই নেহাকে।’’
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রের কথায় সেই প্রত্যয়েরই সুর। বললেন, ‘‘এই ঘটনা প্রমাণ করে, মানুষের মধ্যে সাহায্য করার ইচ্ছে এখনও রয়েছে।’’ নেহার চিকিৎসকদের ‘আদর্শ চিকিৎসক’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন, এই ঘটনাকে সামনে রেখে সমাজ হয়তো এমন আরও অনেক ইতিবাচক ভূমিকা নেবে।
স্বাভাবিক ভাবেই চর্চায় উঠে আসছে কল্যাণমূলক কাজে সোশ্যাল সাইটের ভূমিকার বিষয়টি। যথাযথ ব্যবহার হলে তার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী, সে কথা মানছেন সকলেই। বেশ কিছু দিন আগে কলকাতার এক বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের চিকিৎসার জন্য ফেসবুকের মাধ্যমেই টাকা জোগাড় করেছিলেন সহকর্মীরা। নেহার জন্য সাহায্য এসেছে একই পথ ধরে। ঘটনা শুনে কবি শ্রীজাত বলছেন, ‘‘যদি সচেতন ভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা যায়, তা হলে তার বিরাট শক্তি মানুষকে এককাট্টা করতে পারে। আমি নিজে ফেসবুক ব্যবহার করার সুফল পেয়েছি।’’ শিক্ষক অভিজিৎবাবুরও মত, ‘‘ফেসবুক যে ভাল কাজেও লাগে, এই ঘটনা তারই নজির হয়ে রইল।”
কেন উঠছে এমন কথা? কারণ, বর্তমান যুগে সোশ্যাল সাইটকে হাতিয়ার করে প্রতারণার নজিরও কম নেই। সাইবার বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন, “এই সব ক্ষেত্রে টাকা দেওয়ার আগে অবশ্যই দেখতে হবে কারা টাকা চাইছে এবং কী ভাবে চাইছে। অনলাইন ছাড়াও সরাসরি দেখা করে বা ফোনে কথা বলে বিষয়টা যাচাই করে নিতে হবে।” তবে একই সঙ্গে নেহার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, “এমন সত্যিই বিশেষ ঘটে না। এটা একটা ব্যতিক্রম। অনলাইনের আশীর্বাদ।” ব্যতিক্রম যে, তা বিলক্ষণ মানছেন প্রভাসবাবুও। বললেন, ‘‘কত লোক সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে। কিন্তু দেখুন, এর সাহায্যেই আমরা সবাই মিলে একজনের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারলাম।’’
নেহার অবশ্য এত কিছু বোঝার বয়স এখনও হয়নি। তবে সে এখন অনেকটাই সুস্থ। রোজ ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজেই পরে নেয় বাইপ্যাপ যন্ত্রটা। নিয়মিত বাইপ্যাপ ব্যবহার আর ওষুধপত্র চালু থাকলে নেহার আপাতত আর কোনও বিপদ নেই, জানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
এখন আর ঘুমোতে ভয় করে না নেহার। হাসপাতাল থেকে চলে আসার আগে ‘আঙ্কল-আন্টি’রা অনেক খেলনা কিনে দিয়েছিল। সেগুলো বুকে জড়িয়েই রোজ ঘুমিয়ে পড়ে সে।