আত্মরক্ষার ক্ষমতাই বাড়ায় আত্মবিশ্বাস।
পূর্বকথা
সে রাতের কথা আমি চেষ্টা করলেও ভুলতে পারব না। অফিস থেকে বেরতে একটু দেরিই হয়েছিল। তার উপর বৃষ্টিভেজা কলকাতার জ্যাম কাটিয়ে, জলজমা পেরিয়ে হাওড়া স্টেশন যখন ঢুকলাম, তখন বৃষ্টির দিনের হিসেবে বেশ রাত হয়েছে। ১০টা ১০-এর লোকাল ট্রেনটা ধরব বলে একটু দ্রুত পা চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ ভুঁইফোঁড় তিনটে ছেলে! এরা এত ক্ষণ এখানেই ছিল না কি? চোখে পড়েনি তো! দ্রুত পায়ে চোখে চোখ রেখে আমার দিকেই এগোচ্ছে তো! চার পাশে জমাট অন্ধকার। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল পৃথিবীটা দুলছে। পেশাসূত্রে ফোনে কিছু জরুরি নম্বর রাখা থাকলেও তখন সে সব হাতড়ানোর সময় বা শক্তি কোনওটাই নেই। হাত-পা অবশ হওয়ার মধ্যেই টের পেলাম এক জন পুলিশকর্মী কোত্থেকে এসে বাইক থেকে নামলেন। সে দিন কিয়স্কে বোধ হয় তাঁরই ডিউটি। ওঁকে দেখেই ছেলেগুলো মিলিয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু মেলাল না ভয়টা।
পরের দিন অফিসে এসে এক সহকর্মীকে বলতেই তিনি জানালেন ‘তেজস্বিনী’ কর্মশালার কথা। নামটা শোনাই ছিল। ২০১২-’১৩ সাল থেকেই তো নানা থানার উদ্যোগে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ হাতেকলমে শেখানোর এই উদ্যোগ নিয়েছিল বিভিন্ন থানা। সেই ‘তেজস্বিনী’ কি? সহকর্মী বন্ধু জানালেন, সেইটাই। তবে এখন আরও বড় আকারে হয়। কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে তিন মাস অন্তর বসে এই শিক্ষার আসর। তাও একেবারে বিনা খরচে। শুধু কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে নজর রাখতে হয়। ঘোষণা হলেই নাম লেখাতে হয় সেখানে দেওয়া নির্দেশ মেনে। কাজ এটুকুই। পরের তেজস্বিনী কবে হবে অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে মিলল সুযোগ।
গত ৪ মার্চ থেকে আজ, ৮ মার্চ পর্য়ন্ত পুলিশ অ্যাথলেটিক ক্লাবে চলল এই প্রশিক্ষণ। সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম সেখানে। টানা পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ নিতে মাঠে হাজির প্রায় ২৫২ জন নানা বয়সি মেয়ে। একসঙ্গে শেখা শুরু হল আমাদের।
আরও পড়ুন: অকারণ আতঙ্ক নয়, করোনা রুখতে এ সব সতর্কতা মেনে চলুন
সজোরে কিক করার অভ্যাস বাড়ায় কোমরের জোরও।
৪ মার্চ। সকাল ৮ টা।
পিলপিল করে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা ঘিরে ফেলল মাঠটাকে। আগের দিন একটু বৃষ্টি হয়েছিল। তাই মাঠ থেকে তুলে এনে সিমেন্টের শুকনো জায়গায় শুরু হল আমাদের করসত। ওহো, বলতেই ভুলে গিয়েছি, তার আগে অবশ্য এই কর্মশালার তত্ত্বাবধানে থাকা সহকারী পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণেন্দু পাল জানিয়ে দিয়েছেন সে দিন আমরা কী কী শিখব। প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-পর্বও শেষ। প্রশিক্ষণ শুরুর আগে মেয়েদের আত্মরক্ষা ও তার উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন ডিসি এসটিএফ অপরাজিতা রাই। এর পরই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে টানা ১৫ মিনিট ধরে শুরু হল জগিং ও ওয়ার্ম আপ। হাত-পায়ের আড় ভাঙাতে ভাঙাতে ফিরে যাচ্ছিলাম খেলোয়াড় জীবনে। যেহেতু একটা সময় এই সব ওয়ার্ম আপের নিয়ম মুখস্থ ছিল। তাই বুঝতে পারলাম, কতটা নিষ্ঠা ও নিখুঁত ভাবে এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কেমন ছিল কর্মশালা? দেখে নিন।
এর পর এক মিনিট বিরতি দিয়েই ডাক পড়ল হঠাৎ। সকলকে দেওয়া হল ছোলা-গুড়। আয়রনে ঠাসা খাবার খেয়েই শুরু হল পরের পর্বের কসরত। এ বার আত্মরক্ষার জন্য পরয়োজনীয় কিছু স্টান্স শেখানোর পালা। সরাসরি থুতনিতে ঘা, কখনও বা বুকে জমাটি পাঞ্চ, সঙ্গে নিয়ম মেনে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারার কৌশল। হাত দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কায়দা জানার পর শুরু হল কিক বা লাথি মারার নানা কসরত। কোন কিকে পায়ের পজিশন কেমন হবে, কতটা উঁচুতে উঠবে পা, কী ভাবে প্রতিপক্ষকে নিজের আয়ত্তে এনে হাত-পায়ের সাহায্য ঘায়েল করা যায় সে সব সুচারু ভাবে শেখালেন অরূপ দাস, সুপর্ণা চক্রবর্তী, সোমা মিত্র, সুপ্রিয় কর ও শকুন্তলা চক্রবর্তীরা। ঘড়ির কাঁটা ইতিমধ্যেই সাড়ে ৯টা পেরিয়েছে। সব রকম হাত ও পায়ের স্ট্রাইক শেখার সময়ই আরও বেশি করে পরিচয় হল সকলের সঙ্গে। হাতে-পায়ে জোর বাড়ানোর পদ্ধতি জানানোর পাশাপাশি বেসিক স্ট্রাইকগুলো শেখা শুরু হল। হাত মুঠো করে প্রেস, ক্লিঞ্চ শেখার পর এমনিই একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস বাড়তে শুরু করবে। তবে এই সব কসরত বা কৌশল তখনই কাজে লাগানো যাবে, যখন অভ্যাস ও ডায়েট একে অপরের হাত ধরবে। তই প্রথম দিন শেষ পর্বে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়েও পরামর্শ দিলেন প্রশিক্ষকরা। প্রত্যেকের শরীরের গঠন বুঝে খাওয়াদাওয়ার তালিকাও মিলে গেল হাতেনাতে।
৫ মার্চ। সকাল পৌনে ৮টা।
প্রথম দিনের প্রশিক্ষণের পর এতই তরতাজা লাগছিল যে, দ্বিতীয় দিন আমরা অনেকেই সময়ের একটু আগে পৌঁছে নিজেরাই শুরু করে দিলাম জগিং। তার পর ছোলা-গুড় খেয়ে আগের দিনের সব স্ট্রাইক, ক্লিঞ্চ, পাঞ্চ অভ্যাসের পর ক্ষিপ্রতা ও নজর বাড়ানোর কিছু কৌশলও আয়ত্তে এনে দিলেন প্রশিক্ষকরা।
আরও পড়ুন: করোনায় আক্রান্ত না কি সাধারণ ফ্লু? কী হয়েছে বুঝব কী ভাবে
পাঞ্চ ও কিকের সঙ্গে ক্ষিপ্রতার পাঠও দিলেন প্রশিক্ষকেরা।
সকাল ৯ টা। এ বার একটা নতুন জিনিস শেখা শুরু হল। হাতে হাতে আক্রমণ ঠেকানোর কিছু বিশেষ উপায়। হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট। তাতে হাতের তালু, কনুই, প্রতিপক্ষের বিভিন্ন জয়েন্টে ঘা মেরে তাকে দুর্বল করে দেওয়া... কী নেই! সেগুলো একে অন্যের সঙ্গে ঝালিয়ে নেওয়ার সময় আরও বেশি করে আয়ত্তে আসত শুরু করল। ভুলত্রুটিও হচ্ছিল। সেগুলো ফের শুধরে দিচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। যত ক্ষণ না ঠিক করছি, ছাড় মিলছিল না কিছুতেই!
এ দিনই শেষ পর্বে ফিট থাকার নানা কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গেলেন পুলিশকর্তা রাহুল চক্রবর্তী।
৬ মার্চ। সকাল ৯ টা
তৃতীয় দিনে জগিং-ওয়ার্ম আপ-ছোলা-গুড় সেরে আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ভাগ হয়ে গেলাম। যা যা এই ক’দিন শিখেছি, দেখি সে সবই এ বার করতে হবে প্যাডের উপর। এত দিন সিনেমায় দেখেছি বক্সিং পিলোয় পাঞ্চ অভ্যাস করছেন খেলায়াড়। এ বার সেই ধরনেরই একটু পাতলা প্যাডের উপর শুরু হল আমাদের পাঞ্চ, ওপেন পাঞ্চ (হাত মুঠো না করে জোরে থাবা)। সঙ্গে সব রকমের হাই কিক, লো কিক, স্ট্রাইকগুলোও ঝালিয়ে নেওয়া গেল। এর পর সঙ্গীর সঙ্গে হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটে উঠে এল নানা দরকারি সময়ে কী ভাবে নিজেকে রক্ষা করব সে সব শিক্ষাও। প্রশিক্ষকরা হাতে ধরে শিখিয়ে দিলেন কেউ গলা টিপতে এলে কী ভাবে উপর থেকে সোজা হাতে আড়াআড়ি থাপ্পড়ে তার কনুইয়ের কছে জয়েন্টে আঘাত করা যায়। এর পর কতটা দ্রুততার সঙ্গে তার শরীরকে ভারসাম্যহীন করে গ্রোয়িন এরিয়ায় (তলপেট ও থাইয়ের মাঝে পিউবিক এরিয়ায়) কিক করেই ধরাশায়ী করে দেওয়া যায় তাকে। আততায়ী যদি পিছন থেকে চুল ধরে আক্রমণ করে তা হলে সেই চুল তার হাত থেকে অনায়াসে ছাড়িয়ে কী ভাবে তাকেই মাটিতে ফেলে দেওয়া যায়।
এ দিন শেষ পর্বে সাইবার ক্রাইম ও ব্যাঙ্ক ফ্রডের ক্ষেত্রে কোথায় কী ভাবে নালিশ জানানো যায়, কী কী ধারায় কী কী শাস্তি সে সবেরও খানিকটা পাঠ দিলেন আর এক পুলিশকর্তা শান্তনু চট্টোপাধ্যায়।
৭ মার্চ। সকাল সাড়ে ৯টা।
এ দিনও নিয়ম মাফিক শুরুর সব কাজ সেরে আমাদের জড়ো করা হল মাঠ লাগোয়া সিমেন্টের জায়গায়। সে দিন শেখার তালিকায় এসেছে এক নতুন পদ্ধতি। ধরা যাক, হাতের কাছে তেমন কিছুই নেই। তবে মেয়েদের হাতে একটা ব্যাগ তো বেশির ভাগ সময়েই থাকে। ছাত্রী বা অফিসযাত্রীর পকেটে পেনও থাকতেই পারে। কিছু না থাক, চুলের ক্লিপ তো আছে। ছোট চুল হলে তাও না থাকলে হাতে রয়েছে তো মোবাইল! এগুলোই তা হলে একটা মেয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। মোবাইলকে ঠিক কী ভাবে ধরলে তা দিয়েও কুপোকাত করা যাবে প্রতিপক্ষকে বা পেনের নিব ফুটিয়েও যে রক্তপাত ঘটানো যায়, এই দিন শিখলাম এ সবই। আগের দিনের কিছু অভ্যাস ঝালিয়ে সবাই মিলে জড়ো হলাম মেয়েদের অধিকার, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আইনকানুন জানতে। সুন্দর বোঝালেন আইপিএস পদমর্যাদার অপরাজিতা রাই।
আরও পড়ুন: করোনায় কতটা ঝুঁকি কলকাতার? রোগের মোকাবিলাই বা করবেন কী ভাবে, জেনে নিন
পাঞ্চ, কিকে জমে উঠেছিল আত্মরক্ষার আসর।
৮ মার্চ। সকাল সওয়া ৯টা।
শেষ দিন বলে এ দিন অনেকেরই মনখারাপ। কেউ কেউ আবার কলকাতা পুলিশ ক্লাবেরই আয়োজনে মার্শাল আর্টের কোর্সে ভর্তি হবে বলে ঠিক করে নিয়েছেন। পাঁচ মাস ধরে প্রতি শনি ও রবিবার পুলিশ অ্যাথলেটিক ক্লাবে চলবে তাঁদের প্র্যাকটিস, তাও একেবারে নিখরচায়।
এ দিন সকালে প্রতি দিনের মতোই জগিং, ওয়ার্ম আপ সেরে আমরা এক জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়ালাম। অরূপ স্যরের ক্লাস বরাবরই খুব মজার হয় দেখেছি। হাসিঠাট্টা করেই বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতি থেকে বাঁচার পথ বাতলান তিনি। এ দিন ক্যাম্পে এনেছিলেন একটা ক্যাপ ভরা বন্দুক। বিভিন্ন কায়দায় শিখিয়ে দিলেন কখন কী ভাবে কোনও বন্দুকধারীর লক্ষ্যকে তছনছ করে দিতে হয়।
পিছন থেকে কেউ ওড়নার পেঁচিয়ে ধরে ছিনতাই করতে এলে কখন তার কাছে নতিস্কীকার করতে হবে আর কখন তাকে ধরাশায়ী করাই সমীচীন হবে, শিখিয়ে দিলেন সে সব। এ দিন শিখলাম সেল্ফ ডিফেন্স জানলেও করব আর কোথায় প্রয়োগ করতে গিয়ে আরও বড় বিপদ আসতে পারে তাও বুঝিয়ে দিলেন। তবে প্রয়োগ না করার ক্ষেত্রটি খুব স্বল্প পরিসরের। যেমন, নিজের খালি হাত। এ দিকে উল্টো দিকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ একাধিক মানুষ— তখন কিন্তু আত্মরক্ষার প্রাথমিক পাঠ জেনে লাভ নেই। তখন কাজে আসবে ওস্তাদ মার্শাল আর্টের কৌশল। সেটাও শিখব বলেই ঠিক করেছি মনে মনে। একটু সময়-সুযোগ বার করেই।
এর পর বিশেষ শুরু হল বিশেষ প্রশিক্ষণ। যৌন হেনস্থা ঠেকাতে কী ভাবে একটা মেয়েকে সক্রিয় হতে হবে, কোন পাঞ্চ, কেমন কিক, কতটা বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে, প্রাথমিক ভাবে শিখে নেওয়া গেল সে সব। হেনস্থাকারীর উচ্চতা ও ওজন আন্দাজ করে বদলে যাবে প্রতিরক্ষারও কৌশল। প্রতিপক্ষের পা লক করে, তার হাতকে নিজের আয়ত্তে রেখে কী ভাবে তাকেই মাটিতে পেড়ে ফেলে দেওয়া যায় সে কৌশলও আজ জানা গেল।
শেষ পর্বে আজ আরও এক বার এত দিন ধরে শেখা সব কৌশল ঝালিয়ে আমরা হাজির হয়ে গেলাম শেষ লগ্নের বিশেষ পর্বে। আজ মেয়েলি নানা অসুখ ও তা ঠেকাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আলোচনা করলেন বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গৌরী কুর্মা ও অনুমিত মহাপাত্র। সেখানে বসেই আলাপ হল এমিলি ভদ্রর সঙ্গে। তেজস্বিনীর প্রথম সেশন থেকেই তিনি এই ক্যাম্পগুলো করেন। এই সেল্ফ ডিফেন্সের পাঠ কাজে লাগিয়ে তিনি সম্প্রতি রামপুরহাট স্টেশনে ধরাশায়ী করে ফেলেছেন এক আততায়ীকে। তাঁর জীবনের সেই ঘটনার কথাও এ দিন আমাদের সকলকে জানালেন এই কোর্সের অন্যতম উদ্যোক্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণেন্দু পাল।
এ বার কিট ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। ভাবছি, ওই রাস্তাটা দিয়ে একটু রাত করে আর এক দিন ফিরব। দেখি না, আর এক বার ছেলেগুলোর যদি দেখা পাই! নিজের চোখটাও আত্মবিশ্বাসে ঝিলিক দিয়ে উঠছে যে!
ছবি ও ভিডিয়ো অর্চিষ্মান সাহা।