ঝুঁকির জটিল অস্ত্রোপচারে নতুন জীবন

আবার শজারুর কাঁটার দেবাশিস ভট্ট। তবে এ বার মহিলা সংস্করণ। এবং সমস্যা আরও বহু গুণ জটিল। হৃৎপিণ্ড শুধু বাঁ দিকের বদলে ডান দিকে নয়, তাঁর পাকস্থলী এবং বৃহদন্ত্র পেট থেকে বুকের খাঁজে এসে আটকে ছিল। আর তার জেরে ফুসফুস গিয়েছিল চুপসে। ফলে স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া তো দূরের কথা, ঠিক মতো শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। যেখানে সাধারণ মানুষের শরীরে একটিই প্লীহা থাকে, সেখানে পরীক্ষায় দেখা গেল, তাঁর শরীরে ছোট ছোট অনেকগুলি প্লীহা।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৫ ০১:২৯
Share:

আবার শজারুর কাঁটার দেবাশিস ভট্ট। তবে এ বার মহিলা সংস্করণ। এবং সমস্যা আরও বহু গুণ জটিল।

Advertisement

হৃৎপিণ্ড শুধু বাঁ দিকের বদলে ডান দিকে নয়, তাঁর পাকস্থলী এবং বৃহদন্ত্র পেট থেকে বুকের খাঁজে এসে আটকে ছিল। আর তার জেরে ফুসফুস গিয়েছিল চুপসে। ফলে স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া তো দূরের কথা, ঠিক মতো শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। যেখানে সাধারণ মানুষের শরীরে একটিই প্লীহা থাকে, সেখানে পরীক্ষায় দেখা গেল, তাঁর শরীরে ছোট ছোট অনেকগুলি প্লীহা। সব মিনিয়ে উলটপুরাণের এক আদর্শ উদাহরণ হয়েই বেঁচে ছিলেন ওই তরুণী। একাধিক অস্ত্রোপচার করে তাঁর শরীরকে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরালেন এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিও থোরাসিক এবং ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা।

উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার শর্মিষ্ঠা করের বয়স এখন ২৭। ছোটবেলা থেকে খাওয়াদাওয়ার পরে শুলেই তাঁর শরীরে অস্বস্তি হত। বয়স যত বাড়তে লাগল, তত কমল খাওয়াদাওয়ার পরিমাণ। বাড়ল শ্বাসকষ্টের মাত্রা। যতজন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন, সকলেই গ্যাস-অম্বলের চিকিৎসা করেছেন, ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা কমেনি। শেষ পর্যন্ত এক চিকিৎসক বুকের এক্স-রে করতে বললেন। তাতেই ধরা পড়ল, হৃৎপিণ্ড রয়েছে উল্টোদিকে, চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে ডেক্সট্রোকার্ডিয়া।

Advertisement

কিন্তু সে জন্যই কি সর্বক্ষণ এমন বুক ধড়ফড়? শর্মিষ্ঠাকে রেফার করা হল গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টদের কাছে। তাঁরা আবার এন্ডোস্কোপি করতে গিয়ে দেখলেন ক্যামেরা বুকের কাছে আটকে থাকছে। পেটের দিকে নামানোই যাচ্ছে না। অতএব পাঠানো হল চেস্ট-এর চিকিৎসকদের কাছে। তাঁরা নানা পরীক্ষা করে জানালেন, হৃৎপিণ্ড উল্টো দিকে হওয়ায় যে পর্দা বুক ও পেটকে আলাদা করে, তা খুবই কমজোরি। তাই তাঁর বৃহদন্ত্র ও পাকস্থলী নীচ থেকে ঠেলে উপরে উঠে এসেছে। সেই চাপেই ফুসফুস চুপসে গিয়েছে। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা।

চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, অস্ত্রোপচার করে পাকস্থলী এবং বৃহদন্ত্রকে নীচে নামাতে হবে। আর ডায়াফ্রামটি নতুন করে তৈরি করতে হবে। তবেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তিনি। কিন্তু কোথায় হবে অস্ত্রোপচার? শহরের একাধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল জানিয়ে দেয়, এমন ঝুঁকির অস্ত্রোপচার করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বহু জায়গা ঘুরে শর্মিষ্ঠাদেবীর স্বামী রাজেন্দ্রনাথ কর আসেন কলকাতার এসএসকেএমে। সেখানে চিকিৎসক শুভেন্দুশেখর মহাপাত্র, আমানুল হক, স্বর্ণেন্দু দত্ত, সৌম্যজিৎ ঘোষ এবং দেবজ্যোতি মণ্ডলের একটি দল তাঁর অস্ত্রোপচার করেন। তার পরে ঘণ্টাখানেক ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল তাঁকে। আপাতত শর্মিষ্ঠাদেবীকে বিপন্মুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

অস্ত্রোপচার করে ঠিক কী করা হল? চিকিৎসকেরা জানান, প্রথমে বুকের বাঁ দিক কেটে বৃহদন্ত্র এবং পাকস্থলীকে নীচে নামানো হল। তার পরে ডায়াফ্রামটির দুর্বল অংশ বাদ দিয়ে সেটি পুনর্গঠন করা হল। ফোলানো হল চোপসানো ফুসফুসকেও। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলেছিল এই অস্ত্রোপচার।

বিষয়টিকে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলে মনে করছেন অন্য চিকিৎসকেরাও। হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ বিশ্বকেশ মজুমদার বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে ওই মহিলার ডায়াফ্রামটি অর্ধেক তৈরি হয়েছিল। এটা মারাত্মক ব্যাপার। অস্ত্রোপচার না হলে ওঁকে বেশিদিন বাঁচানো যেত না। কিন্তু সমস্যা হল, এই ধরনের অস্ত্রোপচারে ঝুঁকিও খুব বেশি। সরকারি হাসপাতালে এমন একটা বড় এবং সফল অস্ত্রোপচার খুবই প্রশংসার দাবি রাখে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement