সতর্ক থাকতে হবে প্রত্যেকেই
গত দুই বছর ধরে এই কোভিড ১৯ সংক্রমণ বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের জীবনকেও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। শুধুমাত্র সংক্রমিত হওয়ার কারণে নয়, তাদের শারীরিক, মানসিক এবং মনো-সামাজিক - সব দিক থেকে ক্ষতি হচ্ছে। বাইরের খোলামেলা, খেলাধুলা এবং স্কুলের পরিবেশ ছেড়ে বাচ্চারা আজ চার দেওয়ালের মাঝে আবদ্ধ। গত বছরের তুলনায় এই বছরে, করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে অনেক বেশি সংখ্যায় শিশুরা সংক্রমিত হয়েছে, মোট আক্রান্তের সংখ্যাটাও অনেক বেড়েছে। আমরা এমন অনেকগুলি ঘটনা দেখেছি, যেখানে গোটা পরিবার আক্রান্ত। এই অবস্থায়, কোভিডে শিশুদের খেয়াল রাখার জন্য উপদেশ দিলেন - ভুবনেশ্বর আমরি হাসপাতালের অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা, এমডি, ডিএম নিওনাটোলজি তথা প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ এবং নিওনাটোলজিস্ট, চিকিৎসক জানকি বল্লভ প্রধান।
কেন এত শিশু আক্রান্ত হচ্ছে?
আগের বারের তুলনায় এবার আক্রান্তের সংখ্যাটা অনেক বেশি। অনেক কম বয়সী বাবা-মা রয়েছেন যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন। এবং তাঁদের থেকেই সন্তানের শরীরে ভাইরাস ঢুকেছে। আমরা যতই বলি না কেন, হোম আইসোলেশনে থাকলেও সংক্রমিত মা-বাবার পক্ষে বাচ্চাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকা খুব কঠিন।
শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা - ভারতীয় জনসংখ্যার ৪১ শতাংশই হল ১৮ বছরের নীচে। সিডিসি-র ২০ অক্টোবরের রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকায় মোট জনসংখ্যার ১.৩ শতাংশের বয়স ১৮-র কম এবং করোনার প্রথম তরঙ্গে হাসপাতালে শিশু ভর্তির হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ যেখানে প্রায় ৩৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
ঘরে থাকলেও কি বাচ্চাদের সংক্রমণ হতে পারে?
হ্যাঁ, হতে পারে। যখন আপনার বাচ্চা বাড়িতে বা আশেপাশের পরিবেশে বা পাড়ায় কোনও সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে তখন সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল। তবে অবশ্যই তা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপরে - যেমন ওই সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকার সময়কাল, ভাইরেমিয়ার সময়কাল, কোন পর্যায়ে রয়েছেন ওই সংক্রমিত ব্যক্তি ইত্যাদি।
কী ভাবে বোঝা যাবে আমার বাচ্চাটি করোনায় আক্রান্ত?
আমরা হয়তো অনেকেই জানি যে শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে বেশিরভাগ আক্রান্তই কিন্তু লক্ষণহীন। সংক্রমিত হওয়া এবং লক্ষণ থাকা - এই দুইয়ের মধ্যে কিন্তু বিস্তর ফারাক রয়েছে। সংক্রমিত হওয়া ৯০ শতাংশের মধ্যে কোনও লক্ষণই থাকে না। যে সকল বাচ্চাদের লক্ষণ থাকে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডায়রিয়া এবং সর্দির সমস্যা দেখা যায়। মরসুমি জ্বর যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং রোটা ভাইরাল ডায়রিয়ার ক্ষেত্রেও যে ধরনের লক্ষণ থাকে, কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রেও অনেকাংশে তাই-ই হয়। কোনওভাবে যদি আপনি দেখতে পান, আপনার আশেপাশে কোনও কোভিড রোগী রয়েছে এবং আপনার বাচ্চার এই সমস্যাগুলি দেখা দিয়েছে তবে সন্দেহ বাড়বেই।
কখন আমার সন্তানের জন্য পরীক্ষা করা উচিত?
গলা ব্যথা, জ্বর, রাইনোরিয়া, বমি বমি ভাব, ডায়েরিয়া, অলসতা, এবং ত্বকে ফুসকুরির মতো লক্ষণ দেখলেই শিশুদের পরীক্ষা করানো উচিৎ, যাতে অন্যের দেহে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে। হাসপাতালে ভর্তির আগে বা অস্ত্রোপচারের আগে টেস্ট করানো আবশ্যিক। কোভিডের উপস্থিতি আছে কি না তা জানতে, র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট, আরটি পিসিআর, জিন এক্সপার্ট এবং অ্যান্টিবডি অ্যাসে ইত্যাদি পরীক্ষা করা যেতে পারে।
কখন কোনও শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিৎ?
এটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে রোগের তীব্রতা এবং সম্পর্কিত ঝুঁকির উপর। অল্প লক্ষণযুক্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তিন দিনের কম জ্বর থাকলে, এবং সঙ্গে কাশি, রাইনোরিয়া, এবং লুজ মোশন হলে বাড়িতেই চিকিৎসা করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল, জিঙ্ক, এবং ওআরএস ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। ক্রমাগত পাঁচ দিনের বেশি জ্বর থাকলে কিংবা অলসতা, ডিহাইড্রেশন, বমি, তলপেটে ব্যাথা, শ্বাস কষ্ট বা অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৪ শতাংশের কম হলেই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন। যে সমস্ত বাচ্চাদের নিউমোনিয়া রয়েছে এবং ভেন্টিলটর সাপোর্ট প্রয়োজন, কোনও বাচ্চার ব্লাড প্যারামিটার স্বচ্ছল না থাকলে, বা লেথার্জি থাকলে আইসিইউতে অ্যাডমিট করা উচিৎ।
রেমডিসিভির, স্টেরয়েড, টসিলিজুম্যাব এবং অ্ন্যান্য অ্যাডজাঙ্কট থেরাপির সম্পর্কে কী বলবেন আপনি?
এই চিকিৎসাগুলি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ঘটনা, ওই পরিস্থিতিতে রোগীর অবস্থা এবং রোগের তীব্রতা উপরে (কেবলমাত্র গুরুতর এবং দ্রুত বেড়ে চলা নিউমোনিয়া থাকলে তবেই)। অবস্থা সংকটজনক হলেই ভেন্টিলেটর সাপোর্ট, শক এবং ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্সের মতো লক্ষনের চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
প্রতিরোধক থেরাপি হিসেবে আইভারমেকটিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন বা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ভূমিকা কী?
ক্লিনিকাল স্টাডিতে এর কোনও সুবিধা দেখা যায়নি।
কোনও মায়ের দেহে করোনাভাইরাস থাকলে সেখান থেকে কি সদ্যোজাত শিশুর কোভিড হতে পারে? সেক্ষেত্রে কী করণীয়?
জরায়ুতে বা প্রসবের সময়ে সদ্যোজাত শিশুদের ক্ষেত্রে কোভিডের সম্ভাবনা খুবই কম। যদিও এমন ঘটনা রয়েছে। যদি মা কোভিড পজিটিভ হয়, প্রসবের পরই শিশুকে মায়ের থেকে আলাদা রাখা উচিৎ এবং ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ওই শিশুর টেস্ট করানো প্রয়োজন। যদি ওই অবস্থায় মা বাচ্চাকে ব্রেস্টফিডিং করাতে চান তবে সমস্ত রকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন, ডাবল মাস্কিং, হাত ধোয়া, দূরত্ববিধি মানা ইত্যাদি।
বাচ্চাদের মধ্যে কোভিড পরবর্তী লক্ষণ কী কী থাকতে পারে?
কোভিড পরবর্তী সময়ে বা সংক্রমিত অবস্থায় থাকাকালীন শিশুদের মধ্যে মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (এমআইএস-সি) দেখা যায়। এটি অত্যন্ত বিরল কিন্ত গুরুতর রোগ। এর মৃত্যুর হারও সর্বোচ্চ।
বাচ্চাদের টিকাকরণের কোনও ব্যবস্থা রয়েছে কী?
করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হাত ধোয়া, এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ছাড়াও যেটি আব্যশিক সেটি হল টিকাকরণ। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, আরবের মতো দেশে ইতিমধ্যেই ১২ বছরের উর্ধ্বে থাকা বাচ্চাদের টিকাকরণ হয়ে গিয়েছে। যার কোনও সাইড এফেক্ট নেই। এবং তারা কিন্তু স্কুলেও যাচ্ছে। পাশাপাশি টিকা দেওযার পরে তার সুরক্ষা এবং টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিও দ্রুত চলছে। আশা করি আমাদের দেশেও খুব দ্রুতই বাচ্চাদের জন্য ভ্যাকসিন চলে আসবে।
কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
মিউটেশনের কারণেই কোভিড ভাইরাস দ্রুত বিভিন্ন স্ট্রেনে পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। তৃতীয় তরঙ্গ নিয়ে আশঙ্কা তো রয়েছেই এবং মনে করা হচ্ছে শিশুরা আরও বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হবেন। গবেষণায় কিন্তু এমন কোনও তথ্য নেই। যাঁরা এখনও টিকা নেননি কিংবা যাঁদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল, তাঁদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্বক হতে পারে। আদৌ কী হবে তা জানার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতেই হবে।
পাশাপাশি গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, যে সমস্ত রোগীদের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাঁদের উচ্চ মাত্রায় স্টেরয়েড চলে, অক্সিজেন থেরাপি চলছে, বা যাঁরা ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রয়েছেন, তাঁদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা নসোকোমিয়াল ফাঙ্গাস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ তাঁদের প্রতিরোধী ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। আমরা সকলেই হয়তো জানি এশিয়ার দেশগুলিতে মূলত ভারতের মাটিতে পরিবেশ থেকেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছড়াতে পারে।
কবে শেষ হবে এই মহামারি?
সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হওয়ার আগে এই মহামারী মরসুম এবং অঞ্চল ভিত্তিতে ধীরে ধীরে অতিমারির রূপ নেবে।
বাবা-মা'দের জন্য পরামর্শ -
ঘরে বসে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলুন। প্রয়োজনে ক্লাসের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করুন বাড়িতেই। নিরাপদে থাকুন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খান। ঘরের পরিবেশকে আনন্দময় করে তুলুন। বাচ্চাদের খেলাধুলা করতে বলুন। অন্যান্য কাজ কর্মের সঙ্গে ব্যস্ত রাখুন যেমন গল্পের বই পড়া, আঁকা, লেখা, শিল্প তৈরি ইত্যাদি। পাশাপাশি সময়মতো বাচ্চাদের অন্যান্য আনুষঙ্গিক টিকাকরণ করান।