গবেষণাগারের ইউভি ব্যবহারের পরিবেশ আর বাড়ি কখনওই এক নয়। ছবি: শাটারস্টক
লকডাউনের পর শুরু হয়েছে আনলক পর্ব। কিন্তু আনলক পর্ব শুরু হতেই সমস্যা বেড়েছে অন্যরকম। বাইরে বেরনো মানেই এখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ‘শুদ্ধিকরণ’। মাস্ক, স্যানিটাইজার এই সবের সঙ্গে যোগ হয়েছে পোর্টেবল ইউভি ডিভাইস। অতিবেগুনি রশ্মিতে করোনা ভাইরাস ধ্বংস হবেই— এই বিশ্বাসে ভর করে বাজার জুড়ে বিকোচ্ছে পোর্টেবল ইউভি ডিভাইস। কিন্তু আদৌ কতটা কাজ হয় এতে? ইউভি স্যানিটাইজার বলে আদৌ কিছু হতে পারে কি?
ইউভি স্টেরিলাইজার, ইউভি ডিজইনফেকশন সিস্টেম এই শব্দগুলো এখন বেশ পরিচিত। কিন্তু বাড়িতে ফিরে মোবাইল কিংবা চামড়ার ব্যাগটি অ্যালকোহল ওয়াইপ দিয়ে পরিষ্কার করার পরিবর্তে অনেকেই এখন ইউভি ডিভাইস দিয়ে ‘ভাইরাস মারা’র কথা ভাবছেন। মোবাইল, মানিব্যাগ, জরুরি নথি, টাকা যা-ই হোক না কেন, অতিবেগুনি রশ্মি তার উপর ফেললেই নাকি করোনা পালিয়ে যাবে। এ কথা কতটা ঠিক?
সত্যিটা ঠিক কী?
“যদি এক কথায় উত্তর দিতে হয়, অতিবেগুনি রশ্মির ব্যবহারে ভাইরাস মারা যায়”, বললেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস। সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী জানালেন, “উচ্চ মাত্রার সঠিক ডোজে ভাইরাস মরতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত পেশাদারের প্রয়োজন।”
বাজারে বিক্রি হয় ইউভি ল্যাম্পও। অনেক ক্ষেত্রেই যা চোখের ক্ষতি করছে। ছবি: শাটারস্টক
অতিবেগুনি রশ্মি (ইউভি)-র প্রকার ও কার্যক্ষমতা
সেন্টর ফর ডিজিজ কন্ট্রোল সূত্রে বলা হয়েছে, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ইউভি রশ্মিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ইউভিএ, ইউভিবি, ইউভিসি। পৃথিবীতে এসে পৌঁছানো রশ্মির বেশির ভাগটাই ইউভিএ।
আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় মেডিক্যাল কলেজে প্লাজমা ব্যাঙ্ক, কতটা কাজ করবে এটি?
বেশি ক্ষণ অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে থাকলে ভেঙে যায় ভাইরাসের ডিএনএ, আরএনএ। ফলে ভাইরাস প্রতিলিপি গঠন করতে পারে না, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, এ কথা জানান আইআইএসইআর মোহালির জীববিজ্ঞানী, ভাইরোলজিস্ট ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু পুরোটাই নির্ভর করছে রশ্মির ফ্লাক্স কতটা এবং কত ক্ষণ সংস্পর্শে থাকছে তার উপর। ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতি হিসেবে অতিবেগুনি রশ্মি (ইউভি) ব্যবহার করা হয়, কিন্তু বাজারচলতি জিনিসে মানগত দিক বজায় থাকছে কি না তা বলা সম্ভব নয়। সেটা পরীক্ষা করে বোঝা যেতে পারে, জানান ইন্দ্রনীলবাবু।
অতিবেগুনি রশ্মিতে ভাইরাস মরে এতে কোনও সন্দেহ নেই। ছবি: শাটারস্টক
ইউভি ডিভাইসে ক্ষতি
যে রশ্মি ডিএনএ, আরএনএ ভেঙে দিতে পারে, তা মানুষের ত্বক এবং চোখের পক্ষে অবশ্যই বিপজ্জনক। গবেষণাগারের বিশেষ পরিবেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিষেবায় স্টেরিলাইজেশন বা জীবাণুমুক্তিতে কিছু ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়। হাসপাতালে কিংবা গবেষণাগারে নির্দিষ্ট ডোজের মাধ্যমে যা করা সম্ভব, তা বাড়িতে কখনও সম্ভব নয়, এ কথা জানান মেডিসিনের চিকিৎসক কল্লোল সেনগুপ্ত।
আরও পড়ুন: খুলে যাচ্ছে জিম ও যোগকেন্দ্র, কী আছে কেন্দ্রের নির্দেশিকায়?
আমেরিকার হেনরিফোর্ড হাসপাতালের গবেষণা বলছে, ইউভিসি-২৫৪ কিছু ক্ষেত্রে কাজ করে কারণ এটি ভাইরাসের ডিএনএ, আরএনএ-তে প্রদাহ তৈরি করে। এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং অন্য করোনা ভাইরাস (সার্স কোভ) এবং মিডল ইস্টার্ন রেসপিরেটরি সিনড্রোমের ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে সাফল্য পেয়েছে ইউভি। কিন্তু কোভিড-১৯-এ র ক্ষেত্রে এই গবেষণা এখনও চলছে।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিষেবায় স্টেরিলাইজেশন বা জীবাণুমুক্তিতে কিছু ক্ষেত্রে ইউভি ব্যবহারের চল বহুদিনই। ছবি: শাটারস্টক
আইআইটি খড়্গপুরের রসায়ন বিভাগের গবেষক বিজ্ঞানী অভিষেক বব চক্রবর্তী এই প্রসঙ্গে বলেন, “পেন স্টেট এবং মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষামূলক ভাবে দেখিয়েছে যে, ২০০-৩০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অতিবেগুনি রশ্মি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক ধ্বংস করতে সক্ষম। তাঁদের দাবি, ইউভিবি মূলত সার্স বা কোভিডকে নিশ্চিহ্ণ করতে পারে। আমরা ল্যাবে, হাসপাতালে বা খাদ্য প্রক্রিয়াকারী সংস্থায় বহু যুগ হল ইউভিসি ব্যবহার করে আসছি ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ধ্বংস করার জন্য। সে যন্ত্রগুলি যথেষ্ট দামি। সেগুলো বাড়িতে সেট করা এবং যত্ন নেওয়াও ব্যয়সাপেক্ষ। বাজার চলতি ইউভি স্যানিটাইজারগুলির দাম দেখে, সেগুলির গুণগত মান নিয়ে সংশয় জাগছে। সেগুলি আদৌ ইউভিবি নিঃসরণ করছে কি না, সে সম্পর্কে কী ভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? সে রকম কোনও ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। যত্রতত্র ইউভিসি ব্যবহার একেবারেই নিরাপদ নয়। ত্বকের ক্যানসার এবং চোখের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এর ফলে। গবেষণাগারে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে অতিবেগুনি রশ্মি নিয়ে কাজ করি। যেটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বাড়িতে করা সম্ভব নয়।”
আরও পড়ুন: নিজে থেকে কোভিড টেস্ট করা কতটা জরুরি? কী বলছেন চিকিৎসকরা?
সাম্প্রতিক গবেষণা
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থার (ডিআরডিও) তরফে আল্ট্রা ভায়োলেট ডিজইনফেক্ট একটি টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। দিল্লির লেজার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং গুরুগ্রামের নিউ এজ ইন্সট্রুমেন্টস অ্যান্ড মেটেরিয়ালস প্রাইভেট লিমিটেডের সাহায্যে তৈরি হয়েছে এই টাওয়ার। ১২ ফুট বাই ১২ ফুটের ঘর ১০ মিনিট সময় ধরে এবং ৪০০ বর্গফুট ঘর ৩০ মিনিট ধরে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব এই যন্ত্রের মাধ্যমে। বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার এবং গবেষণাগারের যে সমস্ত জিনিস রাসায়নিকের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব না, এই ইউভি ব্লাস্টার যন্ত্র সে ক্ষেত্রে কার্যকর বলা হয়েছে এমনই। এ ছাড়াও এয়ারপোর্ট, শপিং মল, হোটেল, কারখানা ও অফিসের ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে ডিআরডিও-র তরফে। কিন্তু বাজারচলতি পোর্টেবল ডিভাইস আর এটির তো তফাত রয়েছে। তবে?
মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, “এই রশ্মিতে ভাইরাস মরে, এটা বিজ্ঞানসম্মত হলেও বাজারচলতি ইউভি ডিভাইস বা ইউভি স্যানিটাইজার যন্ত্রের কার্যকারিতা বোঝা সম্ভব একমাত্র পেশাদারদের পক্ষেই। ব্যবসায়িক স্বার্থ কায়েম করার জন্য অনেকেই নানা যন্ত্র নিয়ে আসছেন করোনা আবহে, সেই জায়গাটা কিন্তু প্রশাসনকেই দেখতে হবে। গবেষণাগার আর বাড়ির পরিবেশ কখনওই এক হতে পারে না। তাই বাজারচলতি ইউভি ডিভাইস বা স্যানিটাইজার ব্যবহারের বদলে অ্যালকোহল ওয়াইপ বা সাবান জল অনেক বেশি কার্যকর।”
আল্ট্রা ভায়োলেট ডিজইনফেক্ট টাওয়ার তৈরি করেছে ডিআরডিও। ছবি: পিটিআই
সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘বাজারচলতি যে সমস্ত যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, তা বাড়িতে কী ভাবে ব্যবহার করা হবে? একাংশ অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের অশিক্ষাকে ব্যবহার করতে চাইছে। গবেষণাগার আর বাড়ির পরিবেশ কখনও এক হতে পারে না। এ ছাড়া অতি বেগুনি রশ্মি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তাই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বারবার হাত ধোওয়া, সঠিক ভাবে মাস্ক পরা, স্যানিটাইজ করার নিয়ম মেনে চলতে হবে। এই জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার করলেও যে ভাইরাস মরবেই, তারও প্রমাণ নেই। ফলে একটি সুরক্ষার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে, যেটা আসলে মিথ্যা। এ জাতীয় কোনও ভুয়া যন্ত্রে যাতে সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষতি না হয়, তা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনেরই। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)