অটিজমে যে শিশুটি আক্রান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা দেরিতে ধরা পড়ে। ফাইল ছবি।
এপ্রিল মাসেই আলিপুরদুয়ার থেকে অটিজম আক্রান্ত সুনির্মলকে (নাম পরিবর্তিত) নিয়ে তার মা কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এসে আটকে পড়েছিলেন। ছোট্ট সুনির্মলকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে কালঘাম ছুটেছিল তাঁদের। সেখানে তো চিকিৎসার তেমন কোনও সুবিধা নেই। এই করোনার আবহে কেমন আছে সুনির্মলরা?
আপনি অসুস্থ হলে সেটা প্রকাশ করতে পারেন। হাঁচি এলে নিজস্ব টিসু ব্যবহার করতেও অসুবিধা হয় না। কিন্তু যাঁরা সেটা প্রকাশ করতে পারেন না? আবার ধরুন, আপনার বাড়ির এক সদস্য বিশেষ ভাবে সক্ষম। আপনি অসুস্থ হলে তাঁকে কে দেখবে, এই নিয়ে চিন্তায় হয়রান আপনি। লকডাউনে স্কুলও বন্ধ। তাই অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে করোনা আরও একটা বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, শুধু ভারতেই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অন্তত ১ কোটি। প্রতি ৬৮ শিশুর মধ্যে এক জনের ধরা পড়ে অটিজম। শিশুরা মোটামুটি ৩ বছর বয়সের আগে তেমন ভাবে কথা বলতে শেখে না বলে অটিজম ধরাই পড়ে অনেক দেরিতে। তাই পাশে থাকতে হয় সবসময়।
বাড়িতে যদি অটিজমে আক্রান্ত কেউ থাকেন, কিংবা বিশেষ ভাবে সক্ষম কোনও শিশু থাকে, তারা অসুস্থ হলে কী হবে কিংবা আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের কে দেখবে, এমন চিন্তা করোনা আবহে হওয়া স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে খানিকটা আশার আলো দেখাচ্ছে বিশেষ একটি নেটওয়ার্ক। না সরকারি কোনও নেটওয়ার্ক নয়। তবে সুনির্দিষ্ট ‘কমিউনিটি সাপোর্ট' দিচ্ছে অটিজম সোসাইটি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল। বিশেষ ভাবে সক্ষমদের কথা ভেবেই এই সময় তারা এমন একটা ইতিবাচক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যাতে সেই মানুষগুলো কোনওরকম বিপদে পড়লে কাউকে অন্তত পাশে পান।
আরও পড়ুন: মাথা-ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা? নার্ভের সমস্যা নয় তো? কীভাবে বুঝবেন
সোসাইটির তরফে ইন্দ্রাণী বসু বলেন, “আমাদের অফিস বন্ধ। তাই অফিসের কোনও কাজ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরেও চাপ পড়ে গিয়েছে। কিন্তু এই সোসাইটির সদস্যদের যে বাবা-মায়েরা রয়েছেন, তাঁরা নিজেরা পরস্পরকে সাহায্য করে চলেছেন প্রতি মুহূর্তে।”
বিশেষ ভাবে সক্ষমদের সঙ্গে কেয়ারগিভারদের সম্পর্কও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে। ফাইল ছবি।
কী কী করা হচ্ছে
• এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব পালন করছেন প্রত্যেকে। সেই মতো সার্কেল অনুযায়ী কয়েকটি পরিবার রয়েছে।
• কেউ করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে এবং বাড়িতে ফোন করে খোঁজখবর নেওয়া এবং প্রয়োজন মতো ব্যবস্থা নেওয়া।
• হাসপাতালের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ রেখে চলা।
• পরিবারের সবাই কোয়রান্টিনে গেলে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দেওয়া।
• নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা।
• কোনওরকম কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হলে সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া।
• বাড়িতে থাকতে থাকতে বাচ্চারা অস্থির হয়ে পড়ছে বা সামান্য কিছুতে রেগে যাচ্ছে, এই রকম ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা।
• অনলাইনে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা।
• সংগঠনের প্রত্যেক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যের জন্য একটি মেডিক্যাল ফাইল তৈরি করতে বলা হয়েছে। সেখানে রয়েছে আপৎকালীন যোগাযোগের নম্বর।
• যদি কোনও অটিজম আক্রান্ত বা তার অভিভাবক সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, সংগঠনের নেটওয়ার্ক সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সুপার তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের বোঝাতে যাবেন, কী ভাবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
আরও পড়ুন: নাগাড়ে কাশি, স্বরে বদল ফুসফুস ক্যানসারের উপসর্গ হতে পারে
কারও ক্ষেত্রে অভিভাবক সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন, অটিজমে আক্রান্ত শিশুটিকে দেখার কেউ নেই— সেই সব ক্ষেত্রে কোভিড হাসপাতালগুলিকে বিশেষ দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরে প্রশাসনের সাহায্য খুব জরুরি বলেও উল্লেখ করেন ইন্দ্রাণী। তাঁর কথায়, “রাজ্যের অটিজম সোসাইটির বাবা-মায়েরা নিজেরা নেটওয়ার্ক গড়ে পাশে থাকার চেষ্টা করে চলেছেন। তবে কোনও সংগঠন হিসাবে নয়, স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে। একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও রয়েছে।, যেখানে কেউ কোথাও কোনও সমস্যার খবর পেলেই জানাচ্ছেন, তা এলাকাভিত্তিক ভাবে খোঁজ নিয়ে সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল, অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের হয়তো স্মার্ট ফোনই নেই। তাই এ বিষয়ে প্রশাসনের সাহায্য প্রয়োজন। সরকারের সেফ হোমের ক্ষেত্রে অটিজমে আক্রান্ত কেউ সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হলে যদি কেয়ারগিভারের সেখানে থাকার জন্য ব্যবস্থা করা যায় সেটি দেখাও জরুরি।”
বাড়িতে থাকতে থাকতে বাচ্চারা অস্থির হয়ে পড়ছে। পাশে থাকুন। ছবি: শাটারস্টক
অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগীদের ক্ষেত্রে হোম আইসোলেশনেই রাখা হচ্ছে। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে হাসপাতালে বা সেফ হোমে রাখা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আক্রান্তদের সামলাতে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বাবা-মাকে তাদের সঙ্গে থাকতে দিতে হবে, এমনটাই অনুরোধ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: কোন ভেষজ চায়ের কী গুণ? কখন খাবেন, কীভাবে বানাবেন?
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট প্রশান্তকুমার রায়ের মত, “অটিস্টিক শিশুদের মূল সমস্যা হয় সামাজিকতায়। অনেকেই নিজের সমস্যার কথা বোঝাতে পারে না। অনেক শিশুর কথা বলায় সমস্যা হয়। বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে সেই সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। এ ছাড়া অটিস্টিক শিশুরা অনেক সময়েই নির্দিষ্ট কোনও একটি কাজ নিয়ে মগ্ন থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু তা থেকে বের করে দৈনন্দিন কাজ শেখানো, পড়াশোনা থেরাপির মাধ্যমে করানো হয়। নিয়মিত থেরাপি দিতে পারলে অনেকেই অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। সেই শিক্ষাগ্রহণে কারও সময় হয়তো বেশি লাগে। কিন্তু পরিবার ও পরিপার্শ্ব পাশে থাকলে শেষ পর্যন্ত সেই চূড়ায় পৌঁছতে পারে।”
অন্য দিকে ‘কোভিড ক্রাইসিস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক ফর পার্সন উইদ ডিজঅ্যাবিলিটি’ নামে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও অ-সরকারি সংগঠনের সদস্যরা। একটি মেল আইডি (ccsnpwd@gmail.com), একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং ফেসবুক গ্রপের মাধ্যমে সারা রাজ্যের বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করছে এই অভিনব নেটওয়ার্ক।
এই প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত অরুণাশিস অধিকারী বলেন, “বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের কথা ভেবেই এটি শুরু করা। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরস্পরের পাশে রয়েছি লকডাউনের শুরুর সময় থেকেই।”
আরও পড়ুন: কখন প্রয়োজন ভেন্টিলেটর? কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার এটির?
কী কী করা হচ্ছে এ ক্ষেত্রে
• কেয়ারগিভারদের সচেতন করা, একই সঙ্গে অটিজমে আক্রান্ত শিশুটিকেও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে বোঝানো।
• সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং (অভিভাবক ও শিশু অর্থাৎ আক্রান্ত ও কেয়ারগিভার উভয়েরই)।
• কারও অভিভাবক না পারলে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া।
• টেলিমেডিসিনের বন্দোবস্ত করা।
• সারা রাজ্য জুড়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্যে মেডিক্যাল সংক্রান্ত পরামর্শ।
• বাড়ির কারও করোনা হলে সে ক্ষেত্রে সাহায্য করা।
• স্পেশাল এডুকেটর নেই, স্কুল বন্ধ— সে ক্ষেত্রে বিশেষ সাহায্য করা। এর বেশির ভাগটাই ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে বা অনলাইনে।
• কেউ করোনা আক্রান্ত হলে সংশ্লিষ্ট থানায় ফোন করা, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করা।
• ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের তরফে সাহায্য করা হচ্ছে শারীরিক ভাবে সমস্যা রয়েছে এমন মানুষদেরও।
আরও পড়ুন: করোনা কতটা ক্ষতি করছে স্নায়ুতন্ত্র-মস্তিষ্কে, কী বলছেন চিকিৎসকরা
করোনা আবহে প্রশাসন কী ভাবছে এ নিয়ে?
স্বাস্থ্য দফতরের কোভিড কো-অর্ডিনেটর প্রদীপ মিত্র বলেন, ‘’প্রশাসনের তরফে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে রাজ্যের হেল্পলাইনগুলি সবসময় খোলা রয়েছে। সেখানে ফোন করলেই হবে। বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তি বা অটিজমে আক্রান্তদের কেয়ারগিভাররা যদি তাদের পাশে থাকেন, সহানুভূতির সঙ্গে দেখেন, তা হলে বিষয়টা অনেকটা সহজ হবে।”
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)