ক্যানসারের টার্মিনাল স্টেজ অর্থাৎ অন্তিম পর্যায়ের মানুষদের জন্য কিছু বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন। ফাইল ছবি।
কেমোথেরাপি শব্দটা শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলেও ক্যানসারের মত মারাত্মক অসুখককে জব্দ করতে অত্যন্ত কার্যকর এই চিকিৎসা পদ্ধতি। এদিকে অনেকেই নভেল করোনা ভাইরাসের ভয়ে কেমোথেরাপি নেওয়া বন্ধ রেখেছেন। কেননা কোভিড ১৯ এর সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একদিনে প্রায় লাখে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তাই বলে ক্যানসারের চিকিৎসা বন্ধ করা একেবারে যুক্তিহীন বললেন চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল অঙ্কোলজির বিভাগীয় প্রধান কল্যাণকুসুম মুখোপাধ্যায়।
ক্যানসার কোষের বিস্তার আটকাতে এবং রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কেমোথেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়। নভেল করোনা ভাইরাসের ভয়ে মাঝ পথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিলে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে সাবধান করলেন কল্যাণকুসুম মুখোপাধ্যায়।
কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্বর, পেটে ব্যথা, বমির মত লক্ষণ দেখা যায়। এই সব উপসর্গের সঙ্গে আবার করোনার লক্ষণের মিল থাকায় অনেকেই কেমোথেরাপি নিতে ভয় পাচ্ছেন। ভাবছেন কেমোথেরাপি করিয়ে বোধহয় করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেলেন।
ক্যানসারের এই ওষুধ চিকিৎসার কিছু নির্দিষ্ট আবর্তন আছে। করোনার কারণে ২১ দিন বা ২৮ দিনের মাথায় কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে বললেন কল্যাণকুসুম বাবু। তবে যাঁদের এতে কাজ হবে না সেরকম কয়েকজনকে দরকার অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে কেমোথেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনেই কেমোথেরাপির মাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই 'ডে কেয়ার'-এ কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। সকালে ভর্তি করে কেমোথেরাপি নিয়ে বিকেলের দিকে রোগী বাড়ি ফিরে যান। তবে কিছু কিছু ওষুধ আছে যেগুলি সারা দিন ধরেই নিতে হয়। আবার রোগীর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল না থাকলে চিকিৎসক মনে করলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তবে এখনকার পরিস্থিতিতে রোগীকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে তারপর কেমোথেরাপি দেওয়া উচিত।
কোভিড পজিটিভ হলে রোগীকে ১৪ দিন কোয়রান্টাইনে রাখার পর পুনরায় পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা করানো উচিত বলে পরামর্শ কল্যাণকুসুম বাবুর। গা হাত পা ব্যথা, জ্বর ও অ্যানিমিয়া সহ রোগীরা করোনা সংক্রমণের কথা ভাবলেও পরীক্ষা করে দেখা যায় এঁদের বেশিরভাগই রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত।
আরও পড়ুন: হাসপাতালে অমিল শয্যা, বাড়িতে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসা করবেন কী ভাবে
ক্যানসারের কিছু উপসর্গের সঙ্গে নভেল করোনার উপসর্গের কিছু মিল আছে। তবে কোভিড টেস্ট না হলে যে চিকিৎসা করা হয় না তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে সিএনসিআইতে যে সব রোগী ক্যানসারের উপসর্গ নিয়ে দেখাতে আসেন তাঁদের বেশিরভাগই অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে আসেন। কোভিড পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, ভরসা দিলেন কল্যাণকুসুম বাবু।
১৯৪০ সালে নাইট্রোজেন মাস্টার্ড এবং ফলিক অ্যাসিড প্রতিরোধী ওষুধ দিয়ে কেমোথেরাপির যাত্রা শুরু। এরপর ক্যানসারের চিকিৎসার নানা বিবর্তনে এসেছে টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি কিন্তু কেমোথেরাপির কার্যকারিতা এখনও সমানভাবে নির্ভরযোগ্য। তবে ওষুধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ক্যানসারের এই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্যানসার কোষকে বিনষ্ট করে ফেলা। ক্যানসার কোষ দ্রুতগতিতে বিভাজিত হয় বা অর্থাৎ অনেক বেড়ে যায়। ক্যানসার কোষের বিভাজন শরীরের স্বাভাবিক কোষ বিভাজনের থেকে অনেকটাই আলাদা। কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যানসার যুক্ত কোষের কোষ বিভাজনের চক্র নষ্ট করে দেয়।
সময়ে থেরাপি করিয়ে মারণ রোগ ক্যানসারকে দূরে রাখুন। ফাইল ছবি।
ক্যানসারের বিভিন্ন চিকিৎসার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কেমোথেরাপি। এতে ব্যবহৃত ওষুধ দ্রুত বর্ধনশীল কোষকে ধ্বংস করে ফেলে। ক্যানসার কোষের পাশাপাশি আমাদের শরীরের কিছু দরকারি কোষও দ্রুত বিভাজিত হয়। কেমোথেরাপি করালে সেই কোষগুলিও ধ্বংস হয়, বললেন সিএনসিআই এর মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট পলাশ দে। আর সেই কারণেই কেমোথেরাপির পর নানা শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। ক্যানসার ছাড়াও আমাদের শরীরে কিছু দ্রুত বর্ধনশীল কোষ থাকে। কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত ওষুধগুলি সেই কোষের উপরেও কাজ করে বলে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা যায়।
আরও পড়ুন: কোষ্ঠকাঠিন্য ও অর্শে ভুগছেন? রেহাই পেতে এই সব মানতেই হবে
ক্যানসার যুক্ত টিউমারকে ছোট করতেও কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। অনেকসময় ক্যানসার ছড়িয়ে পড়লে অস্ত্রোপচার করার কোনও উপায় থাকে না। বিশেষ করে স্টেজ ফোর ক্যানসার ও মেটাস্টেটিক স্টেজে পৌঁছে গেলে রোগীকে সামগ্রিক ভাবে ভাল রাখতে ও জীবনকাল বাড়াতে এবং শারীরিক কষ্ট কমাতে কেমোথেরাপির সাহায্য নেওয়া হয় বললেন পলাশ দে। এক্ষেত্রে রোগীর জীবনযাত্রার মান কিছুটা ভাল থাকে। তবে কেমোথেরাপি ক্যানসার কোষ নির্দিষ্ট নয়, শরীরের অন্য যেসব কোষ দ্রুত বিভাজিত হয় সেগুলোও বিনষ্ট করে। বিশেষ করে হেয়ার ফলিকল বা রোম কূপ, বোন ম্যারো বা অস্থি মজ্জা, গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ট্র্যাক্ট ইত্যাদি কিছু কোষের উপরেও প্রতিক্রিয়া করে আর এই কারণেই কেমোথেরাপি চলাকালীন চুল ঝরে যায়, ডায়ারিয়ার ঝুঁকি বাড়ে, গা বমি ভাব থাকে, খিদে কমে যায়, অনেক সময় মুখ শুকিয়ে গিয়ে মুখে ঘা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওরাল পিল ওষুধের সাহায্যেও কেমোথেরাপি করা হয়। তুলনামূলক ভাবে এই চিকিৎসা কিছুটা সুবিধাজনক। রোগী বাড়িতে থেকে কেমোথেরাপি নিতে পারেন বলে তুলনামূলক ভাবে ভাল থাকেন। কোভিড-১৯ এর ভয়ে কেমোথেরাপি নিতে গড়িমসি করে বিপদ বাড়াবেন না।
আরও পড়ুন:বিখ্যাত মানুষের আত্মহত্যার খবরে কি মানুষ আরও বিপন্ন বোধ করেন? কী বলছেন মনোবিদরা
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)