Reels of Children

সমাজমাধ্যমে পুঁজি যখন সন্তান

বাচ্চাকে নিয়ে রিল বা ভিডিয়ো বানান? কিন্তু জানেন কি এ সবের মধ্য দিয়ে অজান্তে সন্তানের বিপদ ডেকে আনছেন অভিভাবকেরাই?

Advertisement

কোয়েনা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪ ০৯:৫৮
Share:

অবসরে রিল দেখা এখন নতুন কিছু নয়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে রিল, শর্ট স্টোরিজ়, ভিডিয়ো কনটেন্টে বাচ্চাদের উপস্থিতি এখন চোখে পড়ার মতো। সমাজমাধ্যম জুড়ে কোনও মা পোস্ট করছেন বাচ্চার আঁকা ছবি তো কেউ সন্তানের গান, নাচে পারদর্শিতার ভিডিয়ো। কখনও আবার কী করে বাচ্চার ন্যাপি পাল্টাতে হয় থেকে কী ভাবে তাকে স্নান করাবেন, শেখাচ্ছেন অনেকে। সদ্যোজাতরাও রয়েছে এই তালিকায়। বাচ্চার স্কুল যাওয়া থেকে খেলাধুলো, পছন্দের খাবারদাবার, পরিবারের একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্রতি মুহূর্তের আপডেট সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে থাকেন অনেকেই।

Advertisement

এর ফলে পোস্টে বাড়ছে লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ার্স, সাবস্ক্রাইবার... রাতারাতি ডিজিটাল ক্রিয়েটর, ইউটিউবার জুটছে নানা খেতাব। বাড়তে থাকা অনুরাগীর সংখ্যা রিয়্যালিটি শোয়ে ডাক পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। সঙ্গে খুলে যাচ্ছে উপার্জনের একাধিক রাস্তা। সমস্যার সূত্রপাত ঠিক এখান থেকেই। সমাজমাধ্যমে সন্তানকে মূলধন এবং তার গুণকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন মা-বাবারা।

বিপন্ন শৈশব

Advertisement

শিশুশ্রম আইনত অপরাধ। অভিনয় থেকে বিজ্ঞাপন, মডেলিং যে সকল পেশায় শিশুরা এখনও কাজ করে, সেখানে শৈশব রক্ষার স্বার্থে রয়েছে নানা নিয়ম। তা মানা না হলে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। কিন্তু যখন সন্তানকে ব্যবহার করে উপার্জন বাড়াতে চান মা-বাবারা, তখন?

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা সুহৃতা সাহা বলছেন, “বিষয়টা নতুন কিছু নয়। নিজের সন্তানকে জাহির করার প্রবণতা আগেও ছিল। সমাজমাধ্যমের দৌলতে এখন তা প্রবল আকার ধারণ করেছে।” যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালমন্দ বিচার না করেই ট্রেন্ডে গা ভাসাচ্ছেন অধিকাংশ মানুষ। তবে এই ট্রেন্ড এখন সমাজের কোনও এক নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আর সীমাবদ্ধ নেই। সমাজমাধ্যমেও ‘তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম’, সন্তানের প্রতি মা-বাবাদের এই মানসিকতার পিছনে অধিকাংশ সময়েই কাজ করে নিজেদের জীবনের অধরা সাফল্য, নিরাপত্তাহীনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা। সুহৃতার কথায়, “সোশ্যাল মিডিয়া এখন বাজারসর্বস্ব। আর সেই বাজারে বাচ্চাকে বিক্রি করে যত রকম ভাবে অন্যের নজর কাড়া যায়, অর্থ উপার্জন করা যায়, এখন তা নিয়ে বাবা-মায়েরা উৎসাহী।” সমস্যা হল, ক্রমশ এটাই সমাজের স্বাভাবিক রূপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এর ফলে অজান্তে বিপদ ডেকে আনছেন অভিভাবকেরাই।

বিপদ যেখানে

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের বক্তব্য, সাময়িক আনন্দের জন্য বানানো এই ছবি-ভিডিয়োগুলি আসক্তিতে পরিণত হলে সমস্যার সূত্রপাত হয়। কখনও বৈচিত্র আনতে কনটেন্ট ‘বিকৃতির’ পর্যায়ে চলে যায়। সে ক্ষেত্রে কনটেন্টটি ভাইরাল করার চেষ্টা হয়তো সফল হয়, কিন্তু বিনিময়ে বাচ্চার সম্মান, সুরক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন তা কতটা কাম্য?

  • সুরক্ষার অভাব: সমাজমাধ্যমে মুখোশের আড়ালে থাকে অপরাধীরাও। বাচ্চার স্কুল থেকে খুঁটিনাটি, পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করলে বিপদের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
  • ট্রোলের শিকার: বহু ক্ষেত্রে ট্রোলিং, অর্থাৎ বাচ্চাটিকে নেতিবাচক মন্তব্য, কটূক্তি, সমালোচনার শিকার হতে হয়, যা তার মনের উপরে চাপ তৈরি করে।
  • ফোমো-র আশঙ্কা: সমাজমাধ্যমে পরিচিতি, প্রশংসায় বাচ্চারা প্রাথমিক ভাবে উৎসাহিত হয়। কিন্তু একইসঙ্গে ভবিষ্যতে তা হারিয়ে ফেলা বা পিছিয়ে পড়ার ভয় অর্থাৎ, ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ (ফোমো) দেখা যায় বাচ্চার মনে। সেখান থেকেই দেখা দিতে পারে অবসাদ, মানসিক সমস্যা।
  • ভবিষ্যতে সমস্যা: বাচ্চাকে নিয়ে রিলস তৈরি করার আগে অধিকাংশ মা-বাবাই সন্তানের মতামত নেন না। কিন্তু সমাজমাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরতে পছন্দ করে না অনেক বাচ্চাই। সে ক্ষেত্রে ছোট থেকেই মনের মধ্যে জন্ম নেয় ক্ষোভ। লাইক, কমেন্টের বন্যায় মা-বাবা খুশি হলেও, অনেক সময়েই বাচ্চাটি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ডা. রাম বলছেন, “আবার এই বাচ্চারাই যখন একটু বড় হয়, স্কুলে যায়, ১২-১৩ বছরে পৌঁছে নিজেকে নিয়ে সচেতন হয়, তখন কিন্তু ছোটবেলার ছবিগুলোর কারণে বিব্রত বোধ করে। বন্ধুমহলে হাসির পাত্র কিংবা হেনস্থার শিকার হয়।”
  • স্বীকৃতির চাহিদা: সমাজমাধ্যমে প্রশংসা পাওয়া অভ্যেস হয়ে গেলে, পরবর্তীকালে প্রতি পদক্ষেপে অন্য লোকে তাকে নিয়ে কী ভাবছে, বাচ্চারা তা নিয়ে সচেতন হয়ে পড়ে। এতে তাদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস ঠিক মতো তৈরি হয় না। কিংবা ‘আমিই সেরা’ এই ধারণা তৈরি হয়ে গেলে, ভবিষ্যতে বাচ্চার বাস্তবে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়।
  • ব্যাহত শৈশব: ডা. জয়রঞ্জন বলছেন, “হয়তো বাচ্চাটা আপন মনে কবিতা বলছে বা গাইছে, কিন্তু যে মুহূর্তে মা ক্যামেরা তাক করবে, বাচ্চাটি সমালোচিত হওয়ার ভয়ে বা প্রশংসা পাওয়ার আশায় নির্ভুল হওয়ার চেষ্টা করবে। এই সচেতনতাই বাচ্চাটির নিজস্বতাকে নষ্ট করে দেবে।”
  • মানসিক সমস্যা: মা-বাবার হাত ধরে ডিজিটাল দুনিয়ায় টিকে থাকার লড়াই গ্রাস করে শিশুমনকেও। ফলে বয়সের সঙ্গে বাড়ে অস্থিরতা, ধৈর্যের অভাব। সঙ্গে রয়েছে ওভার শেয়ারিংয়ের সমস্যা। এক সময় বাচ্চার সেটা অভ্যেসে পরিণত হবে। এর পর তা করতে না পারলে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।

আইন কী বলছে?

সমাজমাধ্যমে কে, কী পোস্ট করবে, তা ব্যক্তি স্বাধীনতার আওতায় পড়ে। তবে সে ছবি, ভিডিয়ো বা রিলে বাচ্চা নগ্ন থাকলে, শিশু সুরক্ষা কমিশন হস্তক্ষেপ করতে পারে। ওয়েস্ট বেঙ্গল চাইল্ড প্রোটেকশন কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায় বলছেন, “ছেলে বা মেয়ে বাচ্চা, বয়সে যতই ছোট হোক, তার জামাকাপড় ছাড়া কোনও ছবি, ভিডিয়ো বা রিল পোস্ট করা আইনত দণ্ডনীয়। তা ছাড়া, বাচ্চাদের অশ্লীল ভঙ্গির কোনও ছবি বা ভিডিয়ো পোস্ট করাও বেআইনি। এ ক্ষেত্রে কমিশন পদক্ষেপ করতে পারে।”

বুঝতে হবে বাবা-মায়েদের

সুদেষ্ণা অবশ্য মানছেন, আইন করে এ সমস্যা মিটবে না। বরং যে সকল মা-বাবারা সন্তানকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করছেন, তাঁদের সচেতন হতে হবে। “অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করার অর্থ তা স্থায়ী ভাবে থেকে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে যে কোনও কনটেন্টে ভিডিয়ো বানানোর আগে, বাবা-মাকে ভাবতে হবে, ভবিষ্যতে বাচ্চার জীবনে তার কী প্রভাব পড়তে পারে।”

  • সন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে, শৈশবকে আগলে রাখতে সমাজমাধ্যমে কতটা পোস্ট করা যায়, কতটা যায় না, সেটা বাবা-মাকে বুঝতে হবে।
  • খেয়াল রাখুন সমাজমাধ্যম যেন বাচ্চার অভ্যেস না হয়ে দাঁড়ায়।
  • বাচ্চা যাতে বাস্তব জীবনে সফল হয়, সে দিকে নজর দিন।

পাশাপাশি সন্তানকেও বোঝাতে হবে এই খ্যাতি, পরিচিতি, জনপ্রিয়তা সাময়িক। ভবিষ্যতে না-ও থাকতে পারে। ভার্চুয়াল জগতের অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে বাচ্চার স্পষ্ট ধারণা তৈরি করে দেওয়া বাবা-মায়েরই দায়িত্ব।

মডেল: অলিভিয়া সরকার, প্রিয়াঙ্গী দাস, মেকআপ: সুস্মিতা বেরা, ছবি: চিরঞ্জীব বণিক, পোশাক: সাত্বিকা, লোকেশন: অঞ্জলি কুঞ্জ, ফুড পার্টনার: হ্যাংলাথেরিয়াম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement