—প্রতীকী চিত্র।
বাড়িটি সারাদিন ভেসে যেত রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিটল্স বা অন্য সঙ্গীতের মূর্ছনায়। বাসিন্দা বলতে এক দম্পতি। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার স্বামীর তীক্ষ্ণ অথচ স্নেহের নজরদারিতে বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন সদ্য অ্যালঝাইমার’স আক্রান্ত তাঁর স্ত্রী। গান-পাগল শুক্লা ভট্টাচার্যের হারানো মনকে ছুঁতেই এই প্রচেষ্টা ছিল ব্রিগেডিয়ার এস পি ভট্টাচার্যের। এক দিন তিনি দেখেন, বাড়িতে শুক্লার দেখাশোনায় আসা নার্সকে নাচতে দেখে শিশুর মতো খুশি হচ্ছেন স্ত্রী। কেন? শুক্লার হারিয়ে যাওয়া যৌবনের স্মৃতির দখল নিচ্ছে শিশুমন।
এর পরেই বড় সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিগেডিয়ার। স্ত্রীর দেখাশোনায় আসা আয়াদের বলা থাকত, ওঁর সঙ্গে খেলতে। যাতে শিশুমনের যত্ন করা যায়। কারণ, এই রোগে দেহের বয়স বাড়লেও মনের বয়স কমে। এক সময়ে শিশুর মতোই সবটা ওঁদের করিয়ে দিতে হয়। ১৯৯৫ সালে ধরা পড়া রোগের চরিত্র মেনে নিয়েই স্ত্রীকে শিশুর যত্নে রাখতেন ব্রিগেডিয়ার। ২০১৫ সালের শেষ দিন পর্যন্ত চলেছিল সেই প্রক্রিয়া। নিজের বাবা ও মায়ের প্রসঙ্গে বলেন বক্তা, লেখক ও ক্রীড়া প্রযোজক জয় ভট্টাচার্য।
২১ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব অ্যালঝাইমার’স দিবস’ উপলক্ষে ‘অ্যালঝাইমার’স অ্যান্ড রিলেটেড ডিজ়অর্ডার্স সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ (এআরডিএসআই) কলকাতা চ্যাপ্টারের আয়োজনে শনিবার হয়ে গেল এক সভা। যেখানে রোগের বিভিন্ন কারণ, ঝুঁকি বা প্রতিরোধ সম্পর্কে হল আলোচনা। ডিমেনশিয়ার বিভিন্ন কারণের একটি অ্যালঝাইমার’স। মূলত বার্ধক্যে হওয়া ডিমেনশিয়া মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে। সঙ্গে আছে আনুষঙ্গিক কারণও। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ। তার পরবর্তী ২০ বছরে সংখ্যাটা বেড়ে হবে প্রায় ১১ কোটি ৫০ লক্ষ। ফলে প্রাথমিক পর্বে রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধ জরুরি।
গবেষণা বলছে, ডিমেনশিয়ার কারণের ৪০ শতাংশ জানা। বাকি ৬০ শতাংশ অজানা। মনোরোগ চিকিৎসক আবীর মুখোপাধ্যায় ও মনোরোগ চিকিৎসক গৌতম সাহার বক্তব্যে উঠে এল শিক্ষার অভাব, হাইপার টেনশন, ডায়াবিটিস, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত, অতিরিক্ত মদ্যপান (সপ্তাহে ২১ ইউনিটের বেশি), ক্ষীণ শ্রবণশক্তি, স্থূলতা, ধূমপান, বায়ুদূষণ, অবসাদ, সামাজিক মেলামেশা কম, শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের মতো সেই ৪০ শতাংশ কারণ। রোগ প্রতিরোধে ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাসকে মান্যতা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। তাতে ফল, আনাজ, গোটা খাদ্যশস্য, যথাযথ ফ্যাট, সামুদ্রিক খাবার বেশি ও দুগ্ধজাত খাবার, রেড মিট কম খেতে বলা হচ্ছে।
নিউরোসাইকোলজিস্ট ঊর্বশী শাহের মতে, মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স কাজ শুরু করে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। এর কার্যক্ষমতাই ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার’স রোগীর ক্ষেত্রে সেটি কাজ করা বন্ধ করে। রোগী ফিরে যান শৈশবের আচরণে। মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে শোনা গেল, ওই রোগে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা।
এআরডিএসআই-এর সেক্রেটারি জেনারেল নীলাঞ্জনা মৌলিক তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘‘চলতি বছরের ওয়ার্ল্ড অ্যালঝাইমার’স রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, জাতীয় ডিমেনশিয়া পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নত প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে।’’ ভুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখে বিভ্রান্ত না হয়ে প্রকৃত কারণ জানায় জোর দিচ্ছেন স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অমিতাভ ঘোষ। তাঁর মতে, হতেই পারে অন্য কোনও রোগের উপসর্গ স্মৃতিভ্রম, যা সময়ে চিকিৎসা করলে সেরেও যাবে। সেই দিকে নিশ্চিত হয়ে তবে ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
মনে রাখতে হবে, ওঁরা আমাদের কঠিন সময়ে ফেলছেন না। বরং ওঁরা বাঁচছেন কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে।