Adolescence

বয়ঃসন্ধিকালের জটিলতা

বয়ঃসন্ধিতে ছেলেদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়। কী ভাবে সামলাবেন অভিভাবকেরা?

Advertisement

সৌরজিৎ দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪ ১০:০২
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

বয়ঃসন্ধিকাল কৈশোর থেকে যৌবনে পর্বান্তর হলেও এর সঙ্গে যুক্ত থাকে অনেক কিছু। শারীরিক তো বটেই, মনের দিক থেকেও আসে পরিবর্তন। এই জটিল প্রক্রিয়া সামলানো অভিভাবক তো বটেই, সন্তানের নিজের পক্ষেও অনেক সময়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কী ভাবে পেরোনো যায় এই কঠিন পথ, পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

পিউবার্টি এবং অ্যাডোলেসেন্স

এই দু’টি পরিভাষা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। শৈশব থেকে যৌবনের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলে অ্যাডোলেসেন্স। পিউবার্টি পড়ে যায় তার মধ্যেই। অধিকাংশ ছেলের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি আসে ১২ বছর থেকে। এই সময়ে তাদের যৌনগ্রন্থি সক্রিয় হয়ে ওঠে যাতে সাহায্য করে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে যে গোনাড-সক্রিয়কারী গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়, সেগুলি ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। ফলে তাদের দেহে নানা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া ডোপামিন, গ্লুটামেট, সেরেটোনিনের মতো নিউরোহরমোন নানা মানসিক পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। প্রসঙ্গত, ডোপামিন, সেরেটোনিন-কে হ্যাপি হরমোন-ও বলা হয় যেহেতু এরা মানুষের মেজাজ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে।

Advertisement

শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়

কিন্তু হরমোন ঠিকমতো নিঃসরণ না হলে, বয়ঃসন্ধিতে হরেক সমস্যা দেখা দেয়, যার কিছুটা মেকানিক্যাল এবং খানিকটা ফিজিয়োলজিক্যাল বলে জানালেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল। তিনি বললেন, “এ সময়ে লং বোনের গ্রোথ সবচেয়ে বেশি হয়। যার ফলে ছেলেদের হাত-পা ধড়ের তুলনায় লম্বা হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, গ্রোথ পেন-ও হয় এই সময়ে। সারা শরীরে ব্যথা হয়, কিন্তু চিকিৎসাযোগ্য কোনও কারণ পাওয়া যায় না। আবার অনেকের ওজন বেড়ে যায়। কারণ এ সময়ে তারা বেশি মাত্রায় বাইরের খাবার খেতে শুরু করে। তাদের শরীরও সেটা দাবি করে এবং এটি ঘটে টেস্টোস্টেরন হরমোনের কারণে। এর ফলে বিভিন্ন অংশের কোলাজেন টিসুর উপরে টান পড়ে। তার থেকেই এই ব্যথাটা হয়। তা ছাড়া, কোনও কোনও ছেলের এই সময়ে গাইনোকোম্যাস্টিয়া হতে পারে।” অর্থাৎ, মেয়েদের মতো তাদের ব্রেস্ট এনলার্জমেন্ট হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেশি চিন্তা করার কারণ নেই বলে পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. মণ্ডল। তাঁর মতে, বয়ঃসন্ধিকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি সাময়িক একটি শারীরিক পরিবর্তন, যা অন্তত দু’বছর দেখা উচিত। কিন্তু এর মাঝে বা পরে সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

অন্য দিকে, ভোকাল কর্ডের পরিসর বেড়ে যাওয়ায় গলার স্বরে পরিবর্তন ঘটে। গায়ে পুরুষালি গন্ধ প্রকট হয়, মুখে ব্রণ হয়। এগুলি ঘটে সেবাসিয়াস গ্রন্থির সেবাম নামক এক প্রকার নিঃসরণের কারণে। গোনাল গ্রন্থির বৃদ্ধির পরে ছেলেদের যৌনাঙ্গ বাড়তে শুরু করে। অনেক ছেলের যৌনাঙ্গের প্রিপিউস প্রথম দিকে ঠিকমতো খোলে না। এ ক্ষেত্রেও প্রথম দিকেই চিন্তার কিছু নেই বলেই অভিমত ডা. মণ্ডলের। তবে হরমোন নিঃসরণের অপ্রতুলতা হেতু এমন হলে বা যৌনাঙ্গ আকারে অতিরিক্ত ছোট থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে টেস্টোস্টেরনের স্তর পরিমাপ করতে হয়। যদি দেখা যায় গোনাডের আকার ঠিক রয়েছে এবং সিমেন নিঃসরণের প্রকাশ ঘটে, তখন চিকিৎসা দেওয়া হয় না। যৌনাঙ্গের আকার বৃদ্ধি করতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। স্বাভাবিক যৌবনের গতি ঠিক আছে বোঝা যায় যদি রাত্রিকালীন পেনাইল ইরেকশন (বিশেষ করে ভোরের দিকে), ওয়েট ড্রিম (অনেকে নাইট ফল বলেন) ও পুরুষসুলভ মানসিক পরিবর্তনগুলি ঘটে। ছেলেরা প্রথম প্রথম অস্বস্তি বোধ করতে পারে, কিন্তু এগুলি সবই স্বাভাবিক। এগুলি না হলেই বরং চিন্তা করা প্রয়োজন।

মানসিক পরিবর্তনে

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “বয়ঃসন্ধির সময়ে ছেলেদের ঠিকমতো গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে সমাজ ও পরিবেশের। এখনকার দিনে মনের দিক থেকে ছেলেরা কিছুটা বড় হলেও পরিবার-পরিজন সেটা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে এমনকি সামলাতে পারেন না। শুধু তা-ই নয়, বয়ঃসন্ধির বিষয়টি নিয়ে ছেলেরা নিজেরাও বিহ্বল হয়ে পড়ে বলে তাদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শরীর বা সত্তা হওয়া সত্ত্বেও প্রাপ্তবয়স্কদের মতো বেশির ভাগ ভূমিকাই সে পালন করতে পারে না। প্রসঙ্গত, গবেষণা করে দেখা গিয়েছে ১৪-১৬ বছরের ছেলেদের মধ্যে ‘কগনিভিটভ এবিলিটি’ অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা জীবনের লক্ষ্য স্থির করা, প্রায়রিটি ঠিক করা... প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই হয়ে যায়। কিন্তু বড়দের যে অভিজ্ঞতা থাকে, তাদের তখনও তা আসে না। আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের যে অংশ, যেটি আমাদের যুক্তি দিয়ে কোনও বিষয়কে বিচার করতে সাহায্য করে, ২২-২৩ বছরের আগে পুরোপুরি পরিণত হয় না। ফলে বয়ঃসন্ধিতে অনেক সময়েই বিপথে চালিত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।” মনে রাখতে হবে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে আসে সহনশীলতা। ঠিক-বেঠিকের বিবেক বোধ তৈরি হয়। যা প্রাপ্তবয়স্কদের হঠকারী না হয়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। কোনও জিনিস চাপিয়ে দিলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে বিদ্রোহ করতে চায়। কিন্তু সেটা যদি তার ভিতর থেকেই আসে, সে নিজের তাগিদেই ঠিক পথে চালিত হয়। একই সঙ্গে তাদের মনে চলে দ্বন্দ্বও— কতটা নিয়মের ঘেরোটোপে থাকব এবং কতটা নিজের স্বাধীনতাকে বজায় রাখব। এই দ্বন্দ্বের জেরেই বাবা-মায়ের সঙ্গে মতানৈক্য দেখা যায়।

কিছু ছেলের ক্ষেত্রে ‘আর্লি পিউবার্টি’ চলে আসে। সময়ের আগে তার বয়ঃসন্ধি চলে আসায়, তার শরীরিক গঠনে পরিবর্তন এলেও, মস্তিষ্ক অনেক সময়ে পরিণত হয় না। এ ক্ষেত্রে সেই ছেলেদের সমবয়সিদের সঙ্গে মিশতে অসুবিধে হয়, ফলে তারা আকৃষ্ট হয় তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত বড়দের প্রতি। বিশেষত সেই সব বড়, যারা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকে না— ক্লাস পালায়, নেশা করে, অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে ইত্যাদি। ফলে এরা অনেক সময়েই বিপথে চালিত হয়। যার কারণে আর্লি পিউবার্টি সমস্যাদায়ক বলেই অভিমত ডা. মুখোপাধ্যায়ের।

অন্য দিকে, আমাদের সামাজিক জীবনও অনেক পাল্টে গিয়েছে। অধিকাংশ বাবা মা-ই এখন কর্মরত। নিজেদের ব্যস্ত জীবনে তাঁরা সন্তানদের সময় দিতে পারেন সামান্যই। তা ছাড়া এখন বিবাহ বিচ্ছেদ, সিঙ্গল পেরেন্টিং-এর মতো কারণেও ছেলেদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব বড় আকার ধারণ করে। তখন এই কিশোররা সমাজের ঘেরাটোপকে বেশি করে ভাঙতে চায়। ফলে নানা সমস্যা তৈরি হয়— অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়া, বড়দের বা মহিলাদের সম্মান না করা ইত্যাদি।

ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, বয়ঃসন্ধি কালের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আত্ম-পরিচিতি বা ‘আইডেনটিটি’। আমি কে বা আমি কী চাইছি? আমি কি যেনতেনপ্রকারেণ প্রচুর অর্থ, বিত্ত, দামি মোবাইল চাইছি? নাকি আরও ভাল পড়াশোনা করে, উচ্চশিক্ষা অর্জন করে ভবিষ্যতের ভাল কেরিয়ার গড়তে চাইছি?— এমন নানা প্রশ্নে বিহ্বল থাকে কিশোর মন। আমাদের চারপাশে কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সংখ্যা যত বাড়ছে তত বাড়ছে এই দ্বন্দ্ব। বহু ক্ষেত্রে এই অপ্রাপ্তি যত বাড়ে তত কিশোররা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, বিপথগামী হয়। কখনও নিজেকে সমাজ থেকে সরিয়ে ফেলে নয়তো চরম পথ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আবশ্যিক।

শুধু তাই নয় ছেলেরা যত বড় হয়, তত বিভিন্ন ক্ষেত্রের চাহিদাও বাড়ে। পড়াশোনার দিক থেকে, সম্পর্কের দিক থেকেও। তা ঠিকমতো সামলাতে না পারলেই দেখা দেয় সমস্যা। যার অন্যতম ভায়োলেন্স— হয় নিজের প্রতি নয়তো অন্যদের প্রতি। সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও কিন্তু নির্যাতনের (গার্হস্থ থেকে যৌন হিংসা) শিকার। সমস্যা হল চাইল্ডহুড সেক্সুয়াল অ্যাবিউসের ক্ষেত্রে ছেলেদের অভিযোগকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা পরবর্তী জীবনে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে। প্রসঙ্গত, ডা আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, স্কুলজীবনে ছেলেরা প্রায়শই শিক্ষকের মারধরের শিকার হয়। যারা এক সময়ে এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়, তারা পরবর্তী জীবনে একই কাজ করে থাকে।

সমস্যার নিরাময় কী?

অভিভাবকদের বুঝতে হবে, বয়ঃসন্ধিতে তাঁদের সন্তানরা বড় হচ্ছে। এই ট্রানজ়িশনের সময়ে তারা অবধারিত ভাবে চাইবে স্বাধীনচেতা হতে। ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, বাবা মায়েদের সেই স্বাধীনতা সন্তানদের দেওয়া উচিত। সে যেমন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারবে, সিনেমা দেখবে, মোবাইলে গেম খেলবে, সিরিজ় দেখবে, তেমনই আবার পড়ার সময়ে পড়াটাও করতে হবে। পরীক্ষায় সাধ্যমতো ভাল নম্বরও পেতে হবে। যে এই সামঞ্জস্যটা রাখতে পারে, তাকে শুধু প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণটুকুই করা উচিত। কিন্তু যারা সেটা করে না, তাদের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের পরিধিটা বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সেটা সারাক্ষণ হওয়া উচিত নয়। তাতেই অভিভাবকদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়বে। অন্য দিকে, অভিভাবকরা সন্তানদের যা শেখাতে চাইছেন, সেগুলি তাঁরাও যেন নিজেদের জীবনে পালন করেন। নিজেদের কালেও কেমন কঠিন সময় এসেছিল এবং সেই সময়গুলি তাঁরা কী ভাবে পার করেছিলেন, সেটা যদি সন্তানের সঙ্গে ঠিকমতো আলোচনা করা যায়, তবে তারাও স্বাবলম্বী এবং অভিজ্ঞ হতে শিখবে।

অন্য দিকে ছেলেদেরও বুঝতে হবে গোটা দুনিয়াটাই চলে বিভিন্ন নিয়মে। বাবা মা-ও যেমন তার ঊর্ধ্বে নন, তারাও নয়। নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের যুক্তিবুদ্ধিকে শাণিতকরতে ক্ষেত্রবিশেষে বড়দের সাহায্য নিলে ‘মানহানি’ হয় না, সেটাও বোঝা দরকার। তবেই তারা আগামী দিনে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে।

মডেল: অভিরূপ সেন; মেকআপ:সুস্মিতা বেরা; ছবি: অমিত দাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement